ইতিহাসের পাতায় পার্ক স্ট্রিটের মাদার টেরিজা সরণী হয়ে ওঠার গল্প
২০০৪ সালে কলকাতার তদানন্তীন মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায় ঘোষণা করেন কলকাতার বিভিন্ন রাস্তার নাম পরিবর্তন করে বিখ্যাত ভারতীয় ও বিশিষ্ট কলকাতাবাসীদের স্মরণে নতুন নাম রাখা হবে রাস্তাগুলির। ঔপনিবেশিক পরিচয়ের মোড়ক ছাড়তে বিগত দশক থেকেই অব্যাহত রয়েছে নাম পরিবর্তনের সেই ধারা। আর সেই পথেই পরবর্তীতে পার্ক স্ট্রিটের নতুন নামকরণ করা হয় মাদার টেরিজা সরণী।

পার্ক স্ট্রিট বর্তমানে মাদার টেরিজা সরণী নামে পরিচিত। যদিও এর একটা ইতিহাস বিদ্যমান। সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিকে বিশ্বের প্রাচীনতম নন-চার্চ সিমেট্রি গুলোর মধ্যে একটি বলে মনে করা হয়। ১৭৬৭ সালে এটি চালু করা হয়, ১৮৩০ সাল পর্যন্ত এখানে কবর দান করা হতো। কবর খানার সামনের রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছিল 'বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড’ হিসাবে, পরে তা পরিবর্তন করে করা হয় পার্ক স্ট্রিট সরণী। পার্ক স্ট্রীটের সেই কবর খানায় অতীতে প্রায় ১৬০০ কবর দেওয়া হয় বলে জানা যায়। তার মধ্যে বেশির ভাগই ব্রিটিশ।
নাম পরিবর্তন সত্ত্বেও শহরের অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা মাদার টেরিজা সরণী এখনও বেশিরভাগ সরকারী নথিপত্রে পার্ক-স্ট্রিট নামেই পরিচিত। একাধিক পুরনো দলিল দস্তাবেজ ঘাঁটলে ১৭৬০ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের রাজধানী 'ক্যালকাটাও’ এরকম একাধিক রাস্তার নাম পরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছে। ১৮৫০ সালের 'বেঙ্গল অ্যান্ড আগ্রা ডাইরেক্টরিতে' পাওয়া তথ্য অনুযায়ী পার্ক স্ট্রিট 'ঘোড়ুস্তান কা রাস্তা' বা 'বাদাম তলা’ নামে পরিণত ছিল।
ওই রাস্তা ধরে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিক বরাবর হাঁটলে লোয়ার সার্কুলার রোডের কাছে উত্তর দিকে একসময়ে ছিল 'নর্থ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি’। পরবর্তী কালে ওই কবরখানা বন্ধ করে সেখানে তৈরি হয়েছে অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চ স্কুল। তৈরি হয়েছে একাধিক ব্যাঙ্কও। তার ঠিক বিপরীত দিকেই রয়েছে 'সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি’। সেখানে শায়িত রয়েছে ডিরোজিও-র মরদেহ। পাশাপাশি অদূরেই লোয়ার সার্কুলার রোডের উপরের সিমেট্রিতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত সহ একাধিক খ্যাত নামা ব্যক্তি কবর দেওয়া হয়।
বর্তমানে যেখানে 'লরেটো হাউস’ বা মিডলটন রো সেখানে একসময় একটি বিশাল বাগানবাড়ি দেখতে পাওয়া যায় বলে জানা যায়। সেটিও পার্ক স্ট্রিট ও পার্শ্ববর্তী এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উইলিয়াম ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড নামে এক ব্রিটিশ ছিলেন বাগানের মালিক। পরে বিভিন্ন সময়ে ওই বাগানবাড়িতে থেকেছেন বাংলার গভর্নর হেনরি ভানিসটার্ট, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পে সহ একাধিক খ্যাতনামা ব্রিটিশ শাসক।
বিচারপতি এলিজা ইম্পে ওই বাগানে হরিণ পুষতেন বলেও শোনা যায়। সূত্রের খবর, পরবর্তীকালে লোকমুখে জায়গাটির নাম হয় ডিয়ার পার্ক। অনেকে মনে করেন সেখান থেকেই পরে ওই রাস্তাটির নতুন নাম হয় পার্ক স্ট্রিট। যদিও বর্তমানে পার্ক স্ট্রিটের নাম পাল্টে করা হয়েছে মাদার টেরিজা সরণি। মাদার টেরিজার সঙ্গে অল্প কিছু যোগ সূত্র থাকলেও বর্তমান রাজ্য সরকার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী রাস্তাটির রাতারাতি বদলে ফেলায় বিস্মৃত হতে দেখা যায় নাগরিক মহলের একাংশকে।