মিস্টার গে ওয়ার্ল্ড-এর মঞ্চে জিতে গেলেন বাংলার এই সমকামী মডেল তথা বিজ্ঞানী!
পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রাম থেকে উঠে আসা গে মডেল তথা বিজ্ঞানী সমর্পণ মাইতি, এই বছরের মিস্টার গে ওয়ার্ল্ড ২০১৮ -এ তৃতীয় স্থান লাভ করেছে।
শহুরে আবদকায়দায় তিনি বিশেষ রপ্ত নন। ইংরাজী বলতে গেলে প্রত্যেক বাক্যে হোঁচট খান। পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামের ২৯ বছরের সমর্পণ মাইতিই দক্ষিণ আফ্রিকার নাইজনায় আয়োজিত মিস্টার গে ওয়ার্ল্ড ২০১৮ প্যাজেন্টে দ্বিতীয় রানার আপ হয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। মডেলিং-এর পাশাপাশি তিনি মস্তিষ্কের ক্যানসার নিয়ে গবেষণাও করেছেন।
আমাদের দেশে এখনও সমকাম একটা 'অপরাধ'। কাজেই এই দেশ থেকে একজনের গে মডেলিং প্রতিযোগিতায় জেতা তো অনেক দূরের কথা, অংশ গ্রহনই যথেষ্ট সমস্যার, সেটা বলাই বাহুল্য। তবে বাধা টপকে এগিয়ে যাওয়াটাই সমর্পণের বরাবরের চলার পথ। যেমন বাধা কাটিয়ে মিস্টার গে ওয়ার্ল্ডের মঞ্চে গিয়েও তাঁকে সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল। ওরকম আন্তর্জাতিক বিশাল মঞ্চ, অথচ তিনি ভাল করে ইংরাজী বলতে পারেন না। তাই প্রথমে একটু বাধো বাধোও ঠেকেছে। তবে পরক্ষণেই নিজের আত্মবিশ্বাসও ফিরে পেয়েছিলেন। তাঁর মতে, যদি জীবনের প্রতি স্পষ্ট, মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গী থাকে তাহলে ভাষাটা কোনও বাধা হয় না।
সমর্পণের জন্ম পূর্ব মেদিনীপুরের সিদ্ধা গ্রামে। সেখান থেকে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে কলকাতায় পা দিয়েও প্রথমে সমস্যায় পড়েছিলেন তিনি। এখানকার শহুরে এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঠিক খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না গ্রামের ছেলেটি। তবে ধীরে ধীরে তার মধ্যেও খুঁজে নেন নিজের মনের মতো লোকজনকে। তাঁর গবেষণার কাজেও তাঁকে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। অনেক অবমাননা, বিদ্রুপ তাঁকে সইতে হয়েছে। কারণ তিনি সমকামী। একসময় সমকামী হওয়ার কারণে সিনিয়র গবেষকরাও তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চাননি। কিন্তু সব বাধা টপকে মস্তিষ্কের ক্যানসার নিয়ে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন সমর্পণ।
গবেষণার কাজ চললেও বরাবরই এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়কে নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন সমর্পন। নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছেন, কোনও সামাজিক সুযোগ সুবিধা তাঁরা পাবেন না। বরং সমাজ থেকে ঝুটবে অসম্ভব অবমাননা, চুড়ান্ত অপমান। প্রতিপদে মুখোমুখি হতে হবে সমাজের বাঁকা চোখের। শহরে তাও অবস্থাটা কিছুটা আলাদা। শহুরে ভদ্রতার আড়াল থাকে। কিন্তু নিজে একজন গ্রামের ছেলে হয়ে তিনি অনুভব করেছেন, গ্রামীন জীবনে সমকামী বা রূপান্তরকামী, বা অন্য যেকোনও ভিন্নকামী মানুষ যোন আরও প্রান্তীক। তাই ক্যানসারের গবেষণার পাশাপাশি সমান তালে সমর্পন এই সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও গভীর গবেষণা চালিয়েছেন।
২০১৬-য় এই গবেষণার কাজ করতে করতেই সন্ধান পেয়েছিলেন মিস্টার গে ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার। তখনই ঠিক করেন ভারতীয় এলজিবিটিকিউ কমিউনিটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন। দুবছর পর এই প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান পেলেন তিনি। তিনি মনে করছেন, তাঁর এই জয়, তাঁর একার নয়। ভারতের এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে জয় পেলেন। বিশ্বমঞ্চে তাঁর এই স্বীকৃতি ভারতের মতো দেশে, যেখানে সমকামকে এখনও অপরাধ বলে ধরা হয়, এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের অধিকারের লড়াইকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি বলছেন নাহলে সংবিধানে বর্ণিত 'সমানাধিকার কোনদিনই মিলবে না'।
লড়াইটা চালিয়ে যেতে চান বলেই অনেক ভাল ভাল ডাক পেয়েও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার এই প্রতিযোগিতা যেন তাঁর চোখ খুলে দিয়েছে। না গেলে হয়তো জানাই হতো না বিশ্বের কত কত দেশ সমকামীদের রূপান্তরকামীদের কত স্বাভাবিকভাবে গ্রহন করেছে। সেসব দেশে কত বাধাহীন নির্ঝঙ্ঝাটে বুক ফুলিয়ে দিন কাটান তাঁরা। সমর্পণও সেভাবে থাকতে পারতেন। সুযোগ এসেছিল। সমর্পন জানান, প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে আসা অনেকেই তাঁকে আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁদের দেশে গিয়ে থাকার জন্য। কিন্তু না, সমর্পন ভারত ছাড়তে চান না। তাঁর যে এখানে অনেক কাজ বাকি রয়েছে। ভারতকেও ওই সব দেশের মতো মুক্ত সমাজের দেশ করে তোলাই তাঁর স্বপ্ন। তার আগে ওই সব দেশে গিয়ে আরামে থাকা মানে তো পালানো। আর লড়াই ছেড়ে কোনদিন পালাননি সমর্পণ মাইতি।
29 year old cancer researcher from Kolkata bags second runner-up title in this year’s Mr Gay World Contest. Congratulations Samarpan Maiti, and all the best for championing the cause of the #LGBTQ community. https://t.co/vU4Ws3ebTj #PrideMonth pic.twitter.com/OsuJ75qlob
— US Consulate Kolkata (@USAndKolkata) June 2, 2018