চার দশক ধরে কলকাতার আগুন নিভিয়ে পদ্ম সম্মান পাচ্ছেন বিপিন গনত্রা
চারদশক ধরে কলকাতার আনাচে কানাচে আগুন নিভিয়ে এবছর পদ্ম সম্মান পেতে চলেছেন বিপিন গনত্রা। স্বেচ্ছ্বাসেবি এই মানুষটি আগুন নেভানোকেই জীবনের ব্রত করে ফেলেছেন।
কলকাতা, ২৫ জানুয়ারি : চার দশকের বেশি সময় ধরে কলকাতার যেখানেই আগুন লেগেছে সেখানেই পৌঁছে গিয়েছেন তিনি। বিপিন গনত্রা। না, তিনি দমকলের কর্মী বা অফিসার কোনওটাই নন। রাজনৈতিক পরিচয়ও নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সাহস, নেশা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের অসাধারণ দৃষ্টান্ত তৈরি করে এবছর ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মশ্রী পুরস্কার পেতে চলেছেন তিনি।
কলকাতার মানুষ বিপিনবাবুর এই সম্মান কার্যত মানবতাকেই স্যালুট জানায়। পদ্ম সম্মানের যে তালিকা এবছর প্রকাশ করা হয়েছে তাতে সমাজসেবা বিভাগে পদ্মশ্রী পুরস্কার বিজেতা হিসাবে নাম রয়েছে বিপিন গনত্রার।
বাংলা থেকে আরও কয়েকজনের সঙ্গে তিনিও এবছর পদ্মশ্রী পেতে চলেছেন। এবছর পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ মিলিয়ে মোট ৮৯ জন পদ্ম সম্মান প্রাপকের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে উজ্জ্বল করছে বিপিনবাবুর নাম।
নাম তো জানা গেল, এবার জেনে নেওয়া যাক মানুষটি সম্পর্কে। বিপিন গনত্রার বয়স ৫৯। তবে ১২ বছর বয়সে বিপিনবাবু তাঁর দাদা নরেন্দ্রকে দীপাবলীর দিন আগুনে পুড়ে মরতে দেখেছিলেন। কিশোর বিপিনের মনে সেই ঘটনা গভীর ক্ষত তৈরি করে। সেইবয়সেই তিনি ঠিক করেন, আর কাউকে আগুনে পুড়ে মরতে দেবেন না। সেই থেকে নিজে প্রাণে ঝুঁকি নিয়ে আগুনে ঝাঁপিয়ে লোকের প্রাণ বাঁচিয়ে চলেছেন বিপিন।
আজ চারদশক হয়ে গেল শুধুমাত্র মানুষকে সাহায্য করার টানে এই কাজ করে চলেছেন তিনি। দাদা যখন মারা যায়, বিপিনবাবু তারপরে স্কুল ছেড়ে দেয়। তারপরে আর বেশি পড়াশোনা হয়নি। এমনটি দমকলের কোনও প্রথাগত প্রশিক্ষণও নেননি বিপিনবাবু। তবুও শুধুমাত্র কলকাতা শহরেই অন্তত শতাধিক ভয়ানক আগুন লাগার ঘটনায় নিজের প্রাণ লড়িয়ে লোককে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি।
জানা গিয়েছে, বিপিনবাবু ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। দিনরাত সজাগ দৃষ্টি রাখেন টিভিতে সংবাদ চ্যানেলে অথবা রেডিওতে। শহরের কোথাও কোনও আগুন লাগার খবর পেয়েছেন কি, সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি ধরে ছুটে যান সেখানে। মাঝে মাঝে খবর জানতে সটান ফোন করে নেন কলকাতার দমকলের সদর দফতরেও।
কখনও কখনও তিনি নিজে খবর পেয়ে দমকলে খবর দিয়ে নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান দমকলবাহিনী পৌঁছনোর অনেক আগে। তারপর সকলে এলে ঝাঁপিয়ে পড়েন আগুন লাগানোর কাজে। কখনও এমনও হয়েছে, প্রথাগত জ্ঞান না থাকলেও শুধুমাত্র মনের জোরে আগুন নেভাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ বাড়ির ভিতরে ঢুকে গিয়েছেন বিপিনবাবু। দমকলের লোকেরাই জোর করে তাঁকে বের করে এনেছে।
একেবারে ছোটবেলায় দমকলের গাড়ি দেখলেই, তাঁর আওয়াজ শুনলেই পিছনে পিছনে দৌড় লাগাতেন বিপিনবাবু। ঘটনাস্থলে পৌঁছে কিছু করতে পারতেন না ঠিকই তবে কীভাবে দমকল কাজ করে সেই দক্ষতা দেখে দেখে রপ্ত করেন। এরপরে ১৯৭৮ সালে প্রথম এমন কোনও আগুন লাগার ঘটনায় হাত লাগান তিনি। তারপর থেকে প্রায় চারদশক হয়ে গেল, এইকাজই করে চলেছেন বিপিন গনত্রা।
বউবাজার বিস্ফোরণ , কলকাতার স্ট্র্যান্ড রোডের আগুন লাগার ঘটনা, নন্দরাম মার্কেটে আগুন অথবা আমরি হাসপাতালে আগুন, বিপিন গনত্র সবজায়গাতেই পরিত্রাতা হয়ে পৌঁছে বহু লোকের প্রাণ উদ্ধার করেছেন। আর সবই করেছেন স্বেচ্ছ্বায়, মানবতার খাতিরে।
বিপিনবাবুর খোঁজ নিলে জানা যায়, সামান্য ইলেকট্রিকের কাজ করেন তিনি। মাসে রোজগার মাত্র ১ হাজার টাকা। তবে কিছু স্বহৃদয় বন্ধু রয়েছেন যারা মাসে ২৫০০ টাকা করে সাহায্য করেন। কখনও কখনও বিপিনবাবু জানেনও না এর পরের বেলা কি খাবেন! কিন্তু তা সত্ত্বেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন বিপিনবাবু। আসলে তাঁর লড়াইটা বেঁচে থাকার নয়, মানবিকতা, মনুষ্যত্বকে বাঁচিয়ে রাখার। তাইতো তিনি এই বয়সেও সুপারফিট। আর এমন মানুষকে সম্মান জানাতে পেরে নিশ্চয়ই ভারত সরকারও গর্বিত বোধ করবে।