দুর্গাপুজোর সাহিত্য : অন্ধকার ঘরটায় তখন জোনাকি ভরা, ছুটছে মনোনীতা, তারপর কী হল
শিলং-এ এক ঝাঁক বৃষ্টি হয়ে যাবার পর আমার মনে হয় এই মাত্র পথ-ঘাট, গাছ-পালা, ঘর-বাড়ি সব জন্মাল। লেডি হায়দরী পার্কের কাছে আমার অফিস । আর আমি থাকি লোয়ার লাছুমিয়ের-এ অফিস কোয়াটার্সে।
'উপহার', তাপস রায়
- শিলং-এ এক ঝাঁক বৃষ্টি হয়ে যাবার পর আমার মনে হয় এই মাত্র পথ-ঘাট, গাছ-পালা, ঘর-বাড়ি সব জন্মাল। লেডি হায়দরী পার্কের কাছে আমার অফিস । আর আমি থাকি লোয়ার লাছুমিয়ের-এ অফিস কোয়াটার্সে। দূরত্ব আধা কিলোমিটার।সিকিম থেকে আনা ঢাউস সাত রঙের ছাতা মাথায় শিলং-এ এই রাস্তায় চলতে আমাকে অনেকে দেখেছে। লিফট দিতে চাইলেও আমি এড়িয়ে গিয়েছি ইচ্ছে করে। বৃষ্টি এলেই আমি রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে চলতে চলতে দেখতে চেয়েছি কী করে জন্মাচ্ছে ধানখেতির গির্জা, লাইটুমুখরার রাস্তা, তার দু'পাশে নাকছাবির মতো তৃপ্ত নাশপাতি ফুলের সাদা । আমি মেলাতে ছেয়েছি ছোটোবেলায় দেখা বাড়িতে গরুর বাচ্চা হবারদৃশ্য। গরু-মায়ের জিভের আদর। গা পরিষ্কার করে দেয়া।
আমাদের বাড়িটা, মানে বাণীপুরের পৈতৃক বাড়িটা এক ঝাঁক গাছ-পালার আড়াল নিয়ে চার ভাই-বোন-কে আগলে বড় করে দিয়েছিল। মানে তেমন উত্তাপ গায়ে লাগতে দেয়নি। আম-জাম-কাঁঠাল-লিচু গাছ তো ছিলই, গ্রামের বাড়িতে তা থাকে। কিন্তু আমাদের বাড়িতে খুব অযত্নে বড় হয়েছিল একটা কাজু বাদাম গাছ। আমার চোখেবিস্ময় ধরিয়ে লাল ও হলুদের মিশ্রণে একটা আপেলের মতো ফল হত। সেই ফলের নীচে ইংরেজি এস অক্ষরের সবুজ একটা কিছু ঝুলত।
মন এলোমেলো হয়ে আছে আজ। লাবান পাহাড় থেকে সাদা মেঘেরা এসে পথঘাট ঢেকে দিচ্ছে মুহূর্তে। আর কেমন একটা মন কেমন করা গন্ধ। নাশপাতি ফুল দেখার পর আমার মনে পড়েছে বাড়ির কথা। মনে পড়েছে ভারি মিঠে হাওয়ায় গরম পড়ার আগের দিন গুলো ম ম করত। ভোরে চোখ মেলতাম ওই বাতাবি ফুলের সাদায়।
লাল বাতির মোড়ে একটা গাড়ি খুব শব্দ করে থেমে গেল। ট্যাক্সির ড্রাইভার খাসি ভাষায় কোয়াই খাওয়া লাল দাঁত বের করে কিছু একটা বলছে। তার কথা আমার কানে যাচ্ছে না। পায়ের পাতার উপর দিয়ে চাকা গড়িয়ে গিয়েছে। ব্যথা লাগছে খুব।
আসলে আজ মন ব্যথ্যায় ভরে আছে। আমাদের বাড়িটার মৃত্যু সংবাদ এসেছে। বেশ কিছুদিন ধরে টের পাচ্ছিলাম শমন আসছে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ! পুজোর ছুটিতে একবার গিয়ে দেখেটেখে আসব। একবার উঠোনের বাবার হাতে লাগানো পেয়ারা গাছটা জড়িয়ে ধরব। টিউবয়েলের হাতল চেপে এক গন্ডুষ অমৃত পান করব। নিজের ঘরের ভেতর ঢুকে গিয়ে ছেলেবেলার হাওয়া-বাতাস একবার বুক ভরে টেনে নেব, সেই সুযোগ আর পাব না !
" বাড়ির কথা ভেবে নিজেকে গাড়ির তলায় ফেলছিলে ?"
অফিসের লোকজন, মানে খারসেতি আর পীরবত বেরিয়ে যেতেই সুমনা খ্যা খ্যা করে ওঠে। পায়ের পাতায় মোটা ব্যান্ডেজ পড়েছে। হাড় ভাঙেনি। তবে থেঁতলে গেছে। সিভিল হাসপাতাল ঘুরিয়ে অফিসের গাড়িতে আমাকে কোয়াটারে পৌঁছে দিয়ে গেছে ওরা।
" তোমার ইররেস্পন্সিবিলিটির কোনো সীমা পরিসীমা নেই। এই যে কচি ছেলে-মেয়ে দু'টির কী হত, একবার ভেবে দেখেছ! আমার কথা তুমি কোনোদিন ভাবনি,
আমাকে ছেড়ে দাও। কিন্তু ওরা? "
ছেলে-মেয়ে
দু'জনেই
একটু
আগে
শুকনো
মুখ
নিয়ে
ঘুর
ঘুর
করছিল।
কিন্তু
মায়ের
তাড়া
খেয়ে
ওরা
পাশের
ঘরে
সেঁধিয়েছে।
ওরা
ক্লাস
ফোর
আর
ক্লাস
ফাইভ।
আমি
মিনমিন
করলাম,
"
কিন্তু
শেষ
একবার
চোখের
দেখাও
দেখতে
পাব
না!
এত
তাড়াতাড়ি
করার
কী
হয়েছিল
!
দাদা
আর
একটু
রয়ে-সয়ে
করতে
পারত!"
"তোমাদের পরিবারে ওই একজনই কাজের মানুষ। আর সব তো অকর্মণ্য, অপদার্থ ! উনি যা করেছেন, ঠিক করেছেন। এখন ছেচল্লিশ লাখ টাকা আসছে। আর কিছুদিন বাড়িটা এমনি এমনি ফাঁকা পড়ে থাকলে জবরদখল হয়ে যেত না, কে বলতে পারে! "
সুমনার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু মন তো সব সময় যুক্তি মেনে চলে না। সে এই শরীরী রত্নদীপের থেকে ঢের ঢের স্বাধীন। তার দু'খানা পাখা আছে। সে হাজার
বারোশো
কিলোমিটার
উড়ে
বাণীপুরের
বাড়ির
মাথায়
গিয়ে
বসে।
সেখানে
মায়ের
কান্না
জড়ানো
কলতলা
দেখে।
বাবার
গায়ের
ঘাম
লেগে
থাকা
ইটের
গায়ে
নাক
ঠেসে
ধরে
ঘ্রাণ
নিতে
চায়।
উঠোনের
পেয়ারা
গাছের
খসে
পড়া
বাকলের
ভেতর
ছিন্নমুল
এক
দম্পতির
সংগ্রামের
ইতিহাস
খুঁজে
বেড়ায়।
" কী রে দীপ, শান্তি মাস্টার বলছিল তুই নাকি আজ অঙ্ক পারিসনি ! তোর দাদা ক্লাসে ফার্স্ট হয়, আর তুই ফেল করবি?" শান্তি মিত্র আমাদের প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার মশাই।
বাবা অফিস থেকে ফেরার পর রোজই ট্রেন থেকে কেনা লজেন্স বা অন্য কিছু এনে আমাদের দিতেন। তিনি হ্যারিকেনের চার দিকে গোল হয়ে বই নিয়ে বসা আমাদের
চার ভাই-বোনের হাতে লজেন্স দিতে দিতে আবার বললেন, "কাল থেকে দাদার কাছে অঙ্ক করবি। যেন আর ভুল না হয়। অ্যানুয়ালে যেন রেজাল্ট ঠিক হয়। "
আমি
অংকে
বরাবর-ই
কাঁচা।
সেটা
স্মরণ
করিয়ে
দিয়ে
সুমনা
চায়ের
কাপটা
অভ্যাস
মতো
ঠক্
করে
টেবিলের
উপর
রেখে
একটা
মেজাজি
স্বর
ধরে
বলল,
"
দেখ
আবার
দু'লাখ
টাকা
যেন
তোমার
মা
হাতে
ধরিয়ে
না
দেন।
যা
জাঁহাবাজ
মহিলা
উনি!
"
কথায়
কথায়
আমার
বিধবা
মাকে
ঠোক্কর
দিতে
সে
ছাড়ে
না
।
এটা
তার
অধীকারের
মধ্যে
পড়ে।
ফলে
সে
আবার
কথা
ফেলে,
সে
কথায়
হিসেব
চনমনে।
"
দেখ,
ছেচল্লিশ
লাখ
তোমরা
চার
ভাই-বোন
আর
তোমার
মা
---
সমান
ভাগে
এক
একজন
পাবে
নয়
লাখ
কুড়ি
হাজার
করে।
একটা
টাকাও
যেন
কম
না
আসে
।
"
শিলং-এ এখনই এতটা ঠান্ডা পড়ার কথা নয়। আমার গায়ে একটা সোয়েটার চাপানোই আছে। তবে কি জ্বর আসবে! আমি একটা চাদর চাইলাম।
ছোটোবেলায়
বাবা
আমাদের
সকাল
বেলায়
ঘুম
থেকে
তুলে
ছাদে
নিয়ে
যেতেন।
সেখানে
অল্প
রোদের
ভেতর
খেজুড়
পাতার
ছোটো
ছোটো
চাটাইয়ের
উপর
বসিয়ে
চাদর
দিয়ে
প্রায়
মুড়ে
দিতেন।
একটুখানি
হাত
বের
করার
উপায়
থাকত
শুধু,
বই-এর
পাতা
ওল্টানোর
জন্য।
দাদার টেলিফোনটা আসার পর থেকে কেবলই মনে হচ্ছে ওই যত্ন যেন চিরকালের জন্য লীন হয়ে গেল। আমাদের বাড়ির চার পাশে মেহেন্দি গাছের বেড়া। মনে আছে বর্ষায় পাতাগুলি লকলক করত। মা ছাঁটতে বললেও বাবা ছাঁটতে চাইতেন না, বলতেন, " দেখছ না, পাতাগুলি কেমন চকচকে চোখে চেয়ে আছে, কী মায়া! ওরাই তো প্রহরী হয়ে আছে আমাদের বাড়ির। ওদের ব্যথা দিলে আর মন লাগিয়ে পাহারা দেবে!"
সুমনা একমুখ বিরক্তি নিয়ে একখানা চাদর ছুঁড়ে দিয়ে বলল, " এই নাও । আমি জেসাস, জিনিয়াদের একটু পড়াতে নিয়ে বসব। ও-ঘরে যাচ্ছি। বার বার ডাকাডাকি করে
ওদের পড়াশুনোর ব্যাঘাত কোরো না । "
পঁচিশে ডিসেম্বর জন্মেছে বলে আমার ছেলের নাম জেসাস। আর মেয়ের চোখ ওর মায়ের মতো কুতকুতে বলে নাম হয়েছে জিনিয়া। নাম টাম সব-ই দাদুর দেয়া।
কিন্তু ওই নামটার কথা মাথায় আসছে কেন! মনোনীতা! ওকে কি জানাব অ্যাকসিডেন্টের কথা ! সামান্য ঘটনা। খবরটা দিয়ে ওকে উদ্বেগে ফেলার কী দরকার ! কতদিন দেখা হয় না ! শিলং-এ ট্রান্সফার হয়ে আসার পর একবারই দেখা হয়েছে। তবে ফোনে যোগাযোগ আছে প্রায় নিয়মিত।
গায়ে চাদরটা টেনে দিয়ে পা দু'টোই টুলের উপর তুলে দিতে একটু আরাম বোধ হল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম ওদের দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে জেসাস, জিনিয়াদের সুর করে পড়ার স্বর শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কিন্তু করে ফোনটা করে ফেলাই স্থির করলাম। এখন ফিসফাস করে কথা বললে, ওরা শুনতে পাবে না। তাছাড়া আমি দেখেছি অসুস্থ হলে প্রিয়জন কাছে থাকলে, কথা বললে, আরাম হয়।
" কিছু হবে না রে দীপ। এখন একটু ব্যথা তো হবেই, অতবড় একটা গাড়ির চাকা পায়ের উপর উঠে পড়েছিল, একটু লাগবে না ! "
কার গলা ! আমি একবার বাঁ দিকে, একবার ডান দিকে ঘাড় ঘোরাই। একেবারে বাবার স্বর। কত বড় বেলা পর্যন্ত জ্বর-টর হলে বাবাই অফিস থেকে ফিরে এসে আমার শুশ্রুষা করতেন। মাথায় জলপটি দিতেন। দুধ-সাবু খাওয়াতেন, আর রাতে জ্বর বাড়লে ফিসফিস করে বলতেন, কিছু হবে না রে দীপ, কাল সকালেই জ্বর নেমে যাবে।
যন্ত্রণা যেন বেড়ে গেছে। ঘুমবো ভেবে সুমনা ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে গেছে। বেশ কড়া ডোজের পেইনকিলার ইঞ্জেকশন পড়েছে, কিন্তু ঘুম আসছে না। কাচের জানালা দিয়ে শিলং পিকের দিকের পাহাড়ের বাড়িগুলির আলো চোখে পড়ছে। জোনাকির মতো মিটমিট করছে।
কত দিন যে ছোটোবেলায় জোনাকি ধরেছি। বাড়ির পেছন দিকে খেজুর গাছের পাশে ভাঁটফুলের জঙ্গল ছিল। ওই ঝোপেই ওরা ঘুরে বেড়াত। ঘরেও ঢুকে পড়ত । হ্যারিকেনের আলো কমিয়ে চৌকির তলায় ঢুকিয়ে আমি ওদের ডাকতাম, আয় আয় আয়। সত্যি সত্যি দু'চারটে ঢুকে পড়ত ঘরে। আমি খপ করে ধরতাম। আমার মুঠোর ভেতরে তখন অলৌকিক আলো জ্বলত। অনেক বড় বেলা পর্যন্তও আমার ওই অভ্যাস ছিল।
একবার
মনোনীতাকে
চমকে
দিয়েছিলাম।
তখন
আমি
শ্রীচৈতণ্য
কলেজে
সেকেন্ড
ইয়ার।
মনোনীতাও।
আমি
লাজুক
ছিলাম,
আর
মেয়েদের
সাথে
মিশতে
পারতাম
না
।
একবার
মনোনীতার
জন্মদিনে
নেমন্তন্ন
হয়েছে।
আমি
একা
একা
যাব
না।
আমাদের
বাড়ি
থেকে
চা-র-পাঁচটা
বাড়ির
পরেই
ওদের
বাড়ি।
এখনকার
মতো
রাত-
ভাঙ্গা
পার্টি
নয়।
কেক-টেকও
নয়।
দুপুর
বেলায়
বাড়ির
রোজকার
খাবারের
সাথে
শুধু
যোগ
হত
পাঁঠার
মাংস
আর
পায়েস।
আমার মা আমার সাথে গেছেন বলে একটা কম দামের ছাপার শাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছিলাম। মা ধান-দুর্বো সহ আশির্বাদ করলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর হাতে পান তুলে
দিতে দিতে মনোনীতা বলেছিল, " দীপদা, তুমি তো আমায় কিছু দিলে না !"
"
কেন,
ওই
যে
শাড়ি
!
"
"ও-তো
মাসিমা
এনেছেন।
তুমি
...?
"
আমি একটু লজ্জিত হয়েছিলাম । মুখে পান পুরে ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলেছিলাম, আচ্ছা, দেখি। একটা কিছু নিয়ে আমি আবার আসছি।
বাড়ি ফিরে ঘরে বসে সাত-পাঁচ ভাবছি, কী দেব ! হাতে পয়সা-কড়িও তো নেই। বাবা টিউশনি করতে দেন না । বলেন, ওতে নিজের পড়ার ক্ষতি হয়। আমাদের কলেজ হাঁটা পথে বাড়ি থেকে পনের মিনিট এর মতো। বাইরে চা-টা খাই না । তাই টাকা-পয়সার দরকারও হয় না। কিন্তু এখন কী করব ! অত যে বড় মুখ করে বলে ফেললাম ! ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে আর ওই ভাঁট ফুলের জঙ্গল ঝলমল করে উঠেছে চোখের উপর।
আমার
হাতে
একটা
কাগজের
ঠোঙা
দেখে
মনোনীতা
ভ্রু
নাচালো।
বললাম,
"চলই
না
তোমার
ঘরে।"
ওর
ঘর
দোতলায়।
দরজাটা
ভেজিয়ে
এসে
মনোনীতা
হই
হই
করে
উঠল,
"
কই,
কী
এনেছ,
দাও।
আমার
উপহার
দাও।
"
"একটু
রোসো।
"
বলতে
বলতে
আমি
চট
করে
ওর
ঘরের
জানালা
দুটো
বন্ধ
করে
দিলাম।
মনোনীতার
অবাক
হতে
থাকা
চোখের
সামনে
আলো
কমিয়ে
হ্যারিকেন
খাটের
তলায়
ঢুকিয়ে
দিয়ে
বললাম,
"হাত
পাতো।
"
" আরে না না, দু'ই হাত। "
আমি তার লালাভ পেতে রাখা হাতের উপরে আলগোছে মুদির দোকানের ঠোঙাটি নামিয়ে রাখলাম।
" কী আছে এতে?"
স্বরে
অধীরতা
আর
কৌতূহল।
আমি
আলতো
করে
ঠোঙার
মুখ
খুলে
দিতেই
এক
ঝাঁক
জোনাকি
বেরিয়ে
এসে
ঘরময়
ছড়িয়ে
পড়ল।
মনোনীতা
অবাক।
ঘরে
তখন
আকাশ
নেমে
তারা
ফুটেছে।
সে
ছোট
বাচ্চাটির
মতো
হাততালি
দিতে
থাকে।
"
ওঃ
বিউটিফুল।
"
সে
উড়তে
থাকা
জোনাকিদের
পিঠে
হাত
বুলিয়ে
দেয়।
পিটপিট
করে
জ্বলে
নিভে
জোনাকিরা
যে
আনন্দ
প্রকাশ
করছিল,
সে
তার
ভাগ
নিতে
থাকে।
তাদের
পিছনে
ছুটোছুটি
করে।
তারপর
একটুকু
ক্লান্ত
হয়ে
এসে
আমাকে
জড়িয়ে
ধরে
ঠোঁটে
চুমু
খায়।
" এ আমার রিটার্ন গিফট দীপু। "
ওই একবারই সে আমার নাম ধরে ডেকেছিল। সে তখন কাঁপছিল, কাঁদছিল, আর বলছিল , "সিমপ্লি ইউ আর গ্রেট । "
" কী হল, এখন ফোন করছ? আজ দুপুরে যে ফোন ধরলে না ? শরীর-টরীর ঠিক আছে তো ?" মনোনীতার গলায় উদ্বেগের প্রকাশ।
আমি হ্যাঁ না, হ্যাঁ না করতে করতে কথা ঘুরিয়ে দিতে বললাম, " জানো তো আমাদের বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেল। "
" কী বলছ দীপদা, কেন ! তোমাদের কী এমন টাকার দরকার ? তোমরা তো সবাই এস্টাবলিশড ! "
মুখ দেখা যাচ্ছে না বটে টেলিফোনে, কিন্তু মনোনীতা্র গলার স্বর শুনে মনে হল, বিদ্যুতের শক খেয়ে ছিটকে পড়েছে মাটিতে।
আহত
ব্যক্তিকে
যেভাবে
দরদ
দিয়ে
মাটি
থেকে
তোলে,আমি
স্বরে
তার-ও
বেশি
হার্দ্যতা
এনে
বললাম,
"
না
না,
এটা
আমার
ডিসিশন
না।
দাদা
ছেচল্লিশ
লাখ
পেয়ে
...
"
" ডিসিশন না মানে!" খুবই উত্তেজিত লাগছে মনোনীতাকে। সে খানিকটা সামর্থের বাইরে গিয়ে চেঁচায়,
" তুমি ওই বাড়ির কেউ না!" বলতে বলতে সে ডুকরে কাঁদতে লাগল। চাদরের তলায় ফোন ঢুকিয়ে নিয়েছি, যাতে আওয়াজ বাইরে না যায়।
সে কাঁদতে কাঁদতে বলে চলে, " তোমরা সবাই কি শেকড়হীন মানুষ ?
জ্ঞানেন্দ্রভবন, মানে জেঠুর নামাঙ্কিত ওই বাড়িটি আর থাকবে না! তোমরা এটা কী করলে দীপদা !"
আমি বাক্যহীন হয়ে আছি। মনোনীতা এই খবরে অ্যাতটা রি-অ্যাক্ট করবে ভাবিনি। ফোন ধরা আছে। সে তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
"
জানো
তো,
মাসে
একবার
আমি
বাণীপুরে
বাপের
বাড়িতে
যাই।
শুধু
তোমাদের
বাড়িটা
চোখের
দেখা
দেখব
বলে
যাই।
কোনোদিন
ও-বাড়িতে
তো
ঢুকিনি,
ঢুকতে
পারব
না
জানতাম।
কিন্তু
ঈশ্বরকে
না
দেখেও
তো
লোকে
তাকে
অবলম্বন
করে,
বাঁচে।
তুমি
আমার
বাঁচাটা
কেড়ে
নিলে
দীপদা
!"
"
এই
কী
বলছ
তুমি,
কেন
এমন
বলছ
?"
আমার
গলা
ফ্যাসফেসে,
আর
বিরক্তি
মাখানো।
আমি
ভাবছিলাম,
না
বললেই
পারতাম।
নিজেদের
পারিবারিক
ব্যাপার
বাইরের
লোককে
জানিয়ে
ফ্যাসাদ
ডেকে
আনার
দরকার
ছিল
না
।
শরীরের ব্যথার সাথে আবার মনোকষ্ট যোগ হতে যাচ্ছে।
মনোনীতা
ফুঁপিয়ে
চলেছে
তখনও।
"
আমি
চাইনি।
বাবা
রেলের
পাত্র
আর
হাবড়ার
ভেতরই
হবে
বলে
হিজলপুকুরে
আমার
শ্বশুড়বাড়ি
বানিয়ে
দিল।
কিন্তু
আমি
মন
থেকে
কোনদিন
তোমার
পাশে
কাউকেই
বসাইনি।
তুমি
আমার
মনের
দেবতা,
আর
তোমাদের
বাড়ি
আমার
মন্দির
।
"
এ
কী
বলল
মনোনীতা
!
কই
এর
আগে
তো
কক্ষনো
বলেনি
সে!
আমার
ভালো
লাগত
তাকে।
কথা
না
বললে
মন
খারাপ
হত।
কিন্তু
মন
খারাপের
পিছনে
তেমন
করে
কোনো
যুক্তি
উঠে
আসেনি
।
আমার
চোখ
বুজে
আসছিল।
মনোনীতার
মনের
ব্যথা
আমার
ভেতর
ঢুকে
পড়তে
চাইছে।
অন্ধকার
ঝাঁপিয়ে
পড়েছে
ঘরে।
মনে
হচ্ছে
জ্ঞান
হারাব।
প্রায় দিন পনের বাদে আমি গুয়াহাটির ডাউন টাউন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছি। পায়ে সেপ্টিসেমিয়া হয়ে গেছিল। আই সি ইউতে ছিলাম। কলকাতা থেকে দাদা,ভাই,বোন সবাই এসেছিল। বাঁচবার কথা ছিল না। ডাক্তাররা জানিয়েও দিয়েছিল তা। কিন্তু একবার শেষ চেষ্টা হিসেবে একটা ইংজেকশন পুশ করে। সেটার দাম এক লাখ দশ হাজার টাকা।
আমাকে শিলং যাবার জন্য অফিসের পাঠানো গাড়িতে তুলে দিয়ে দাদা বলল, "জানিস একটা খারাপ খবর আছে। "
আমি দাদার মুখের উপর গাড়ির জানালা দিয়ে প্রশ্নের মতো করে চোখ ফেললাম।
" আমাদের বাড়িটা আর বিক্রি হচ্ছে না রে। মানে আর কেউ কিনতে চাইছে না।" বাড়ি বিক্রি না হবার খবরে মনের আনন্দ মনে চেপে রেখে জিজ্ঞাসা করি, "কেন, কেন কিনতে চাইছে না?"
"জানিস
তো,
আমাদের
বাড়ির
সামনের
দিকে,
রাস্তার
পাশে
যে
বড়
সজনে
গাছটা
ছিল,
তাতে
একটা
বউ,
কী
যেন
নাম
বলল,
ও
হ্যাঁ,
মনোনীতা,
গলায়
দড়ি
দিয়ে
দিন
পনেরো
আগে
সুইসাইড
করেছে।
"
যোগাযোগ-
তাপস
রায়।।
৫৫৩
পি
মজুমদার
রোড।
কলকাতা-৭০০০৭৮।
৯৪৩৩০৮৭৮৫৬
[email protected]