এই পরিবারে আটটি দুর্গা পুজো,দেবীর ভোগে রয়েছে পান্তাভাত আর ইলিশমাছের মাথা দিয়ে কচুশাক
কলকাতার অন্যতম পুরনো পুজোগুলির মধ্যে রয়েছে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো। এবছর এই পুজো পা দিল তম ৪১০তম বর্ষে।
কলকাতা তথা বাংলার অন্যতম পুরনো পুজোগুলির মধ্যে রয়েছে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো। এবছর এই পুজো পা দিল ৪১০ তম বর্ষে।
পুজো কবে ও কীভাবে শুরু
১৬১০ সালে বঙ্গদেশে এই পুজো শুরু হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে এই পুজোর বয়স কলকাতা শহরের বয়সের চেয়েও পুরনো। এই পুজোর বয়স ৪১০ বছর। ১৬১০ সালে লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় মজুমদার চৌধুরি এই পুজো শুরু করেছিলেন। সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গা পুজোর সঙ্গে অন্য বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোর বিস্তর ফারাক। পুজো শুরুর দু'বছর আগে পরিবারের কর্তা লক্ষ্মীকান্তকে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর দক্ষিণ বঙ্গের আটটি পরগনার নিষ্কর জায়গিরদারি দেন| পরিবারের এই লক্ষ্মীলাভের কারণে লক্ষ্মীকান্তর স্ত্রী ভগবতী দেবী স্থির করলেন বাড়িতে দুর্গোৎসব করবেন | সেই থেকেই এই বাড়িতে দুর্গা পুজো শুরু।
এই পুজোর হাত ধরেই বঙ্গে প্রথম একচালায় পুজো শুরু হয়
পরিবারের সূত্রে জানা গেল, ১৬১০ সালে এই পুজোর হাত ধরেই বঙ্গে প্রথমবার দুর্গা-লক্ষ্মী-সরস্বতী, কার্তিক-গণেশকে এক চালচিত্রের মধ্যে এই সঙ্গে একই তিথিতে পুজো করা হয়। এর আগে বঙ্গে যতগুলি পুজো হত সবগুলিতেই দুর্গাপুজোতে দুর্গাকে একক চণ্ডীরূপে আরাধনা করা হত।
একমাত্র পরিবার, যেখানে পরিবারে আটটি দুর্গা হয়
এই পরিবারে মূল পুজোটি হয় দক্ষিণ কলকাতার বড়িশা অঞ্চলে।বড়িশাতেই পরিবারের মধ্যে ৬টি দুর্গা পুজো হয়। আটচালা বাড়ি, বড় বাড়ি, মেজ বাড়ি, মাঝের বাড়ি, কালীকিংকর বাড়ি, বেনাকি বাড়ি। বড়িশা অঞ্চলে এই ছটি বাড়ি ছাড়াও বিরাটি ও তার পাশে নিমতা পাঠানপুর বাড়িতে এই পরিবারের দুর্গা পুজো হয়। সব মিলিয়ে মোট আটটি বাড়িতে পরিবারের দুর্গা পুজো হয়।
আট বাড়ির প্রতিমার আঙ্গিকগত পার্থক্য ও রীতি
এই আট বাড়ির মধ্য বড় বাড়ি, মেজ বাড়ি ও নিমতা পাঠান বাড়ীতে প্রতিমার ঘোড়া বৈষ্ণব মতে ঘোটক সিংহ অর্থাৎ ঘোড়ার মতো দেখতে হয়। বাড়ি পাঁচটি বাড়ির প্রতিমায় সিংহের রূপ সাধারণ সিংহরূপের মতো। বড় বাড়ি ও বিরাটি বাড়িতে নবমীর দিন কুমারী পুজো হয়। এই পরিবারের সব বাড়িতে আমিষ ভোগ দেওয়া হলেও নিমতা পাঠানপুর বাড়িতে পুজোর চারদিনই দেবীকে নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়।
দেবীর রূপ
প্রাচীন রীতি অনুসারে দেবীর মুখমন্ডল পানপাতার মতো। ত্রিনয়ন টানা, গায়ের বর্ণ শিউলি ফুলের বোঁটার রংয়ের মতো অর্থাৎ গাঢ় কমলা। পরিবারের কোনও কোনও বাড়িতে প্রতিমার গায়ের রঙ গাঢ় কমলা। কোনও কোনও বাড়িতে প্রতিমার গায়ের রঙ স্বর্ণবর্ণা। গণেশের রং লাল । রাজপুত্র বেশে কার্ত্তিক।চালচিত্র তিনভাগে বিভক্ত এবং তাতে দশমহাবিদ্যার ছবি আঁকা থাকে। দেবীর সঙ্গে তাঁরা সকলেই পূজিত হন। অতীতে প্রথা অনুযায়ী, ১৩টি পাঁঠা ও একটি মোষ বলি হত। বর্তমানে সর্বসম্মতভাবে সব বাড়িতে পশুবলি সম্পূর্ণ বন্ধ।
বিশেষ পুজো
অপদেবতাকে সন্তুষ্ট করতে মহাষ্টমী ও মহানবমীতে বিশেষ মাষভক্ত বলির নিয়ম।বড় বাড়িতে হয় অর্ধরাত্রি পুজো। বিরাটীর বাড়িতে হয় ধুনোপোড়া, পবিত্র সন্ধিপুজোর সময়ে নিমতা-পাঠানপুর বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় সাবর্ণ কুলদেবী মাতা ভুবনেশ্বরী দেবীর বিশেষ পুজো ও ক্ষীরের পুতুল বলি দেওয়া হয়।
দেবীর ভোগে রয়েছে পান্তাভাত আর ইলিশমাছের মাথা দিয়ে কচুশাক
দশমীর দিনে বিশেষ ভোগের রীতি রয়েছে। দশমীর দিন দেবীকে পান্তাভাত ও ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুশাক ও চালতার চাটনি দেওয়া হয়।পরিবারের রীতি মাকে ভোগ দিয়ে ঐ দিনই ঐ বছরের জন্য শেষবার পরিবারের লোকজন ইলিশ মাছ খাবে। এই পরিবারের আটটি পুজোর মধ্যে এখনও কয়েকটি পুজোয় কাঁধে করে বিসর্জনের রীতি মেনে আসা হচ্ছে। অন্য বাড়িগুলিতে নিজেস্ব পুকুরে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়।