দর্জিপাড়ার এই বনেদি দুর্গাপুজোর পা ২১৩ তম বর্ষে, পদ্ম নয় এখানে দুর্গা পূজিত হন ১০৮ অপরাজিতা ফুলে
উত্তর থেকে দক্ষিণ, কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোয় লুকিয়ে কতশত ইতিহাস। ঐতিহ্যের বনেদি বাড়ির পুজো বললেই উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের দর্জিপাড়ার মিত্র বাড়ির পুজো না দেখলে বড় মিস!
উত্তর থেকে দক্ষিণ, কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোয় লুকিয়ে কতশত ইতিহাস। ঐতিহ্যের বনেদি বাড়ির পুজো বললেই উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের দর্জিপাড়ার মিত্র বাড়ির পুজো না দেখলে বড় মিস! ১৯, সি, নীলমণি মিত্র স্ট্রীটের মিত্র বাড়িতে এখন সাজো সাজো রব। মা আসতে বাকি আর যে মাত্র কয়েক দিন। এ বাড়ির বনেদি পুজো এবার পা দিল ২১৩ তম বর্ষে।
পুজো শুরু কীভাবে ও এই পুজোর ইতিহাস
ইংরেজ আমলে নীলমণি মিত্র ছিলেন অভিজাত পরিবারের ছেলে। একবার ইংরেজ সরকারের এক অনুরোধ পূরণ করতে না পারায় ব্রিটিশরা তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল। সেসময় পরিবার নিয়ে তিনি বেনারসে চলে যান। সেখানেই তিনি প্রয়াত হন। পরবর্তী সময় তাঁর পুত্রও বেনারসে মারা গিয়েছিলেন। এরপর নীলমণি মিত্রর বিধবা পুত্রবধূ তাঁর ছেলেদের নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসে নীলমণি মিত্রের কাকা দুর্গাচরণ মিত্রের কাছে আশ্রয় নেন। সেখানেই একদিন নীলমণি মিত্রের বড় নাতি প্রাণকৃষ্ণ মিত্র খেলার ছলে বন্ধু প্রতিমা শিল্পীদের সঙ্গে বসে কালী প্রতিমা তৈরি করেন। পরে এই দেবীকে পুজো করা হয়। এই পুজোর পরই পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়। এরপর প্রাণকৃষ্ণ মিত্রের পরের ভাই রাধাকৃষ্ণ মিত্র বাড়িতে দুর্গো পুজো শুরু করেন। সেই থেকেই রাধাকৃষ্ণ মিত্রর হাত ধরে দুর্গো পুজো শুরু যা এবছর ২১৩ বছরে পড়ল। পরবর্তী সময়ে রাধাকৃষ্ণের মেজ ছেলে রাজকৃষ্ণ মিত্র এই পুজোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেই থেকেই এই পুজো রাজকৃষ্ণ মিত্র বাড়ির পুজো বলেও বিখ্যাত।
মহিলাচালিত বনেদি দুর্গা পুজো
রাধাকৃষ্ণ মিত্রের পঞ্চম বংশধরের কোনও ছেলে না থাকায় এখন বাড়ির মেয়েরাই এই পুজোর পরিচালনা করে থাকেন। বর্তমানে মিত্রবাড়ির পুজোর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন বাড়ির মেয়ে অনসূয়া বিশ্বাস। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল মিত্র বাড়ির দুর্গা পুজোর ইতিহাস।
এই বাড়ির দুর্গা প্রতিমার বৈশিষ্ট্য
মিত্র বাড়ির প্রতিমার বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এবাড়ির প্রতিমা তিনচালার। প্রতিমার পিছনে মঠচৌরির কাজ রয়েছে। অর্থাৎ মাটির নকশা করা তিনটি মঠের চূড়ার আকৃতির চালি। প্রতিমার পিছনে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীর দেবীমুখ ও কার্তিক ও অসুরের মুখ সাধারণ মানুষের মতো। বাংলা ধাঁচের মুখের বিশেষত্ব, প্রতিমার চোখ মানুষের মতো হয় আর দেবীমুখের বিশেষত্ব হল প্রতিমার চোখ টানা টানা হয়। মিত্র বাড়ির প্রতিমায় দুই ধাঁচের মিশ্রণই রয়েছে। দুর্গা, সরস্বতী ও লক্ষ্মী প্রতিমার দেবীমুখের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে প্রতিমার মুখে ছাঁচ বংশ পরম্পরায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়। ঐ ছাঁচেই প্রতি বছর তিন দেবীর মুখ তৈরি করা হয়।
পদ্ম নয়, দেবী পূজিত হন ১০৮টি অপরাজিতা ফুলে
এ বাড়ির দুর্গা পুজোয় পদ্ম নয়, ১০৮টি অপরাজিতা ফুল ব্যবহার করা হয়। এবাড়িতে খিছুড়ি ও মিছড়ি, মাখনের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। এবাড়িতে পুজোর কোনও নৈবেদ্যই আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করার নিয়ম নেই। সেকারণে পরম্পরা ধরে রেখে প্রতি বছর সৌরশক্তির সাহায্যে করা হয়। অর্থাৎ রোদে ফেলে তা নেড়ে নিয়ে নৈবেদ্য তৈরি করা হয়।
পশু বলি প্রথা বন্ধ হওয়ার পিছনে রয়েছে এক কাহিনি
পরিবারে অন্যতম সদস্য অনসুয়া দেবী জানান, এর আগে এই বাড়িতে ছাগশিশুর বলির প্রচলন ছিল। একবার রাজকৃষ্ণ মিত্রের পায়ের কাছে ছাগল এসে আশ্রয় নিয়েছিল। এরপর থেকেই পশুবলি প্রথা বন্ধ হয়ে যায়।
মিত্র বাড়ির বিসর্জন দেখার মতো
আজও এবাড়িতে বিসর্জনের একটা নিয়ম রয়েছে। প্রাচীন প্রথা মেনে মিত্র বাড়ির পুরুষ সদস্যরা কাঁধে করে প্রতিমা বিজর্সন দিতে যান।