দুর্গাপুজোর সাহিত্য: তরুণ কবি ঋত্বিক দত্তের সেরা ১০টি কবিতা
কথার উপরে শব্দের প্রলেপ দিতে ভালবাসে ঋত্বিক দত্ত। আর সেখান থেকে সে সৃষ্টি করে চলে একের পর অসাধারণ কবিতা। লেখা-র সঙ্গে সঙ্গে ইলাস্ট্রেশনেও সমান পারদর্শী সদ্য তারুণ্যে পড়া ঋত্বিক।
কথার উপরে শব্দের প্রলেপ দিতে ভালবাসে ঋত্বিক দত্ত। আর সেখান থেকে সে সৃষ্টি করে চলে একের পর অসাধারণ কবিতা। লেখা-র সঙ্গে সঙ্গে ইলাস্ট্রেশনেও সমান পারদর্শী সদ্য তারুণ্যে পড়া ঋত্বিক। তার কবিতা যেন এই সব অনবদ্য ইলাস্ট্রেশনের সঙ্গে ডানা মেলে মুক্তি বিহঙ্গের মতো উড়তে থাকে।
মূলত সমকালীন সমাজ- তার বিভিন্ন ঘটনাকে সে তার কবিতায় তুলে ধরতে ভালবাসে। লেখা-র প্রতি প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে মেধাবী ছাত্রও বটে ঋত্ত্বিক। এছাড়াও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও রয়েছে সমান বুৎপত্তি। তার চরিত্রের মধ্যে থাকা সৃষ্টিশীল মেজাজটা তাকে ভাব আর ভাবনার 'সংমিশ্রণ' সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে শিখিয়েছে। দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে থাকল ঋত্বিকের কিছু অসামান্য কবিতার সংকলন।
।।শিল্পী।।
রঙিন মঞ্চ, ফুটলাইট, আর ধোঁয়া,
এসব দিয়েই ভরা থাকে চারপাশ
রক্ত-মাংস প্রাণ-মন সব থেকেও
যন্ত্র আমরা, আনন্দ দেওয়াই কাজ।
রঙিন মঞ্চে রাজা হই আমরা
রাজার ক্ষমতা মঞ্চেই সীমাবদ্ধ
মাথার ওপর আলো যদি নিভে যায়,
জীবিকা তখন হয় বিপন্ন বড্ড।
যাদের সুখে পরচুলা, গোঁফ পরে,
শিল্প-পূজায় হারাই আপনারে
ওপারের সেই মুখগুলো ভোলে তাকেই
হাততালি-ঝড় বয়ে যাওয়ার পরে।
।।স্বাধীনতার আগে-পরে।।
আজ সভ্য-স্বাধীন আমরা
শত বুট জুতো, ব্যাটন-বুলেটে
বিদ্ধ করে চামড়া,
আজ সভ্য-স্বাধীন আমরা।
আগে গোরা শত্রু নিপাত করতে
প্রাণ করা হত পণ,
আজ ভাই ভাইয়ের রক্ত ঝরাতে
দিয়েছে সকল মন।
ধর্ম, যাকে রক্ষা করতে
জেগেছিল হোমানল,
আজ তা হয়েছে রক্ত সাগর
উপার্জনের কল।
দেশমাতা, নানা সংগ্রাম পরে,
রক্ষা শেষে পেলেও
কেন আজ তাও মা বোনেরা
সিলিং থেকে ঝোলে?
সভ্য হয়েছি স্বাধীন হয়েছি
চলেছি হাজার পা
তবুও যেন পুরোপুরি ভাবে
সভ্য আমরা না।
।।দীপাবলি।।
প্রদীপ
শিখার
আলোর
কাছে
আঁধার
মানে
হার,
আতশবাজিতে আকাশ ভরে উঠছে বারংবার।
হিয়ার আগুন জ্বলছে যেন প্রদীপ শিখার 'পরে,
ধূপ হয়ে তারই ধোঁয়া ভরেছে সারা ঘরে।
প্রদীপশিখার কম্পনশীল আলোর সহায় হয়ে,
চলেছি কারো অন্বেষণে, ব্যাকুল হৃদয় নিয়ে।
পথ আমাদের গিয়েছে সরে একে-অপরের থেকে,
জানিনা কবে পাবো আবার তোমায় পথের বাঁকে।
আন্দোলিত জলের মতো টুকরো স্বপ্নগুলো
জুড়বে আবার?নাকি তাতে পড়বে কালের ধুলো?
বিজলিবাতির তীব্র আলো সয় না আর চোখে,
তাই জেলেছি হৃদয় প্রদীপ পথের বাঁকে বাঁকে।
হয়তো আজ আলাদা হলাম বিধির বন্ধনীতে,
হয়তো আবার মিলব কোনও দীপাবলির রাতে।
।।শহুরে ব্যাধি।।
এ শহরের আজ কঠিন অসুখ,
গলিতে গলিতে ছোটে রিক্ততার জীবাণু,
ছড়ায় জীর্ণতা কোষ থেকে কোষে,
প্রাণের শেষ বিন্দুটি ধরে রাখার
অনবরত বিফল চেষ্টা চালিয়ে
আজ যে শহর ক্লান্ত!
সে তফাত বোঝে না জ্বলন্ত রৌদ্রে
আর স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায়,
তার দিন-রাত কাটে
অট্টালিকায় ছেয়ে যাওয়া
ক্ষুদ্র আকাশটির পানে
নিস্পলক দৃষ্টি হেনে।
কখনও কোষে-কোষে জাগে তাণ্ডব,
দাম্পত্য থেকে সামাজিক,
বা সামাজিক থেকে ধার্মিক,
চার দেওয়ালের ভেতর ও বাহির কেঁপে ওঠে
মুহূর্মুহূ কলহের আঘাতে,
গভীর
হয়
শহরের
ক্ষত,
ধীর
হয়
স্পন্দন,
থেমে আসে শ্বাস-প্রশ্বাস,
এখন সামনে শুধুই অন্ধকার।
।।সবুজ বিরোহী।।
হে সঞ্জীবনী পৃথ্বী, জীবনের আধার তুমি,
নানা উপাধিতে ভূষিত, মাতৃ রূপে পূজিত।
তবু কেন তোমারই একাংশ
আজও শুন্য কোলে, ভগ্ন হৃদয়ে
একাকী কাটায়ে দিতেছে তাহার সমস্ত আয়ু?
বলো পৃথ্বী,
কেন চিরবন্ধা নারী রূপে
পরে আছে ওই
বালুকাবিলাষী মরু?
সূর্যোস্নাত তার দেহে কেন
খেলে না নরম ঘাসের ঢেউ,
কেন তার বুকে শোনা যায় না
পাখির মধুর কলতান?
কেন তার মায়াবী মরীচিকার আড়ালে
লুকিয়ে থাকে বিষাক্ত শুষ্ক মৃত্যুফাঁদ?
জবাব পাই নাই, আর আশাও করিনা,
মরুর উদ্ভ্রান্ত ঝড় সে আশাকে
উড়ায়ে নিয়েছে আরো তপ্ত উপত্যকায়,
যেথা বারিধারা ভয়ে ঝরে না,
যেথা বালুর অশি হাতে দাপিয়ে বেড়ায়
উন্মত্ত বাতাস দস্যু,
সেথা আশা বালুপাশে আবদ্ধ হয়ে
তলিয়ে যায় মাটির গভীরে,
সেথা মেলে না সবুজের দেখা।
তাই তো তুমি মরু, রূপের আধার তুমি,
তবু তুমি বন্ধ্যা, তুমি সবুজ বিরহে কাতর,
তুমি মরু, নিষ্প্রাণ ধু ধু মরু।
।।রক্তকরবীর চিঠি।।
প্রিয়
অলি,
আজ
চলে
গেলে
তুমি
আমায়
ছেড়ে,
অনেক অনেক দূরে,
কোনও এক নতুন বাগানের
নতুন ফুলের কাছে।
তার নরম সুগন্ধী পাঁপড়ির আড়ালে
আজ তোমার ঠাঁই।
তা তো হবেই, আমি যে আজ পুরাতন,
আমার যে দাম কমে গেছে
তোমার
প্রেয়সীদের
মাঝে।
তবে
আজ
যখন
চলেই
গেলে
তখন বলে রাখা ভালো,
আমি সুন্দর সুগন্ধি গোলাপ নই,
যে লালের লালসা মেটাতে
এসেছিলে আমার বুকে,
তা প্রেমের লাল নয়,
সেই
লাল
লোহিতবর্ণ।
যেই
বুকের
মধু
পান
করেছিলে
এতদিন,
তা বহুকাল আগেই বিষিয়ে গিয়েছিল
বারংবার আঘাতের হাত ধরে।
যে বিষ লুকোনো ছিল আমার রূপের আড়ালে
আজ তারই দহন তোমার ধমনীতে
হাহাকার হয়ে বইবে,
ছারখার করে দেবে তোমার শ্রী,
রক্ত পিপাসু হয়ে হরণ করবে তোমার প্রাণ
এখনও না বুঝে থাকলে বলে রাখি,
আমি লোহিতবর্ণা,রক্তিম,
আমি রক্তকরবী।
।।জন্মান্তর।।
কত দিন, মাস, বছর পেরিয়ে,
শহরের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে,
জন্ম থেকে জন্মান্তরে
খুঁজেছি যে শুধু তোমারে।
ফুলের
গন্ধ
বাতাসে
তার
রেশটুকু
রেখে
গেছে,
হাতের স্পর্শ, পুরোনো সে কত
এখনও যায়নি মুছে।
রাতের আঁধার তুচ্ছ করি
খুঁজি শুধু সেই আলোর দিশারী
পথের ক্লান্তি বুকেতে হারায়,
যেন সুখ-হীন সারি।
মন্ত্র আজানে হয় পরিণত,
ক্রুশ হাতে কভু মাথা হয় নত,
চোখ তবু থাকে সেই ভীড়-মাঝে
বুকে জ্বলে সেই ক্ষত।
কোনও সে জন্মে, বহু যুগ আগে
কথা দিয়েছিলে ভরা অনুরাগে
দেখা হবে ফের দুজনার মাঝে,
মিলন অস্তরাগে।
সেই কথা নিয়ে হৃদয়ের মাঝে,
চলেছি এই জীবনের সাঁঝে,
খুঁজেছি অনেক, এখনো খুঁজবো,
অচেনা মুখের মাঝে।
।। ফিরে পেতে চাওয়া ।।
আকাশের গাঁয়ে বৃষ্টি আজ আর নেই
মেঘ তার বুকে ভাসছে যত্রতত্র,
শরৎ শেষের আকাশে উড়ছে তারই
ব্যর্থ প্রেমের ছিন্ন প্রেমপত্র।
মেঠো সুরে যেন গাইতো না তার মন
লাগত না ভালো খোলা মাঠের হওয়া,
তাই তো গেঁয়ো আকাশটাকে ছেড়ে
শহুরে আকাশে তার এই চলে যাওয়া।
তখন সন্ধ্যা, জ্বলেছে প্রদীপ গ্রামে
যাচ্ছে আকাশ অন্ধকারে মিশে
অন্যদিকে রিমঝিম কলতানে
শহরের গলি যাচ্ছে জলে ভেসে।
হয়তো তার ছিল না চাকচিক্য
সাদামাটা মতো ছিল তার ভালোবাসা,
তাই হয়তো ছেড়ে গিয়েছে সে তাকে
দেখতে শহুরে ঝলমলে সব আশা।
তবুও আজও নীল রং আছে তার
মনে শুধু আছে একটিমাত্র খেদ,
একবারটি আসতো সে যদি ফিরে
আষাঢ়ের সেই কাজল-কালো মেঘ।
।।একলা আকাশ।।
আকাশ
কি
সত্যি
সত্যি
একা?
রাতেরবেলা সারা আকাশজুড়ে
ফুটে যে ওঠে হাজার গ্রহ-তারা,
তারা কি শুধু থাকে দূরে দূরে,
হয়ে শুধু আত্মস্বার্থে হারা?
চাঁদের ও তো দেখা মেলে রাতে
স্নিগ্ধ আলোয় ভরে তার বুক
পথ সে চলে আকাশেরই সাথে সাথে
দুঃখ কাটিয়ে আনে তার মনে সুখ।
সেও তো যায় আঁধারেতে মিশে
ক্ষয় ধরে তার মুগ্ধকরা রূপে
অমাবস্যায় আকাশকে না বলেই
ঝাঁপ দেয় কোনো অন্ধকার কূপে।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে জাগে আশা,
নব-প্রভাতের নতুন ভালোবাসা
সেও চলে যায় ক্লান্ত দিনের শেষে
পশ্চিমের রক্ত স্রোতে ভেসে।
দিনের মতো কেটে যায় দিন
এক এক করে পেরিয়ে যায় মাস,
প্রিয়জন সব চলে যায় বহু দূরে,
পড়ে থাকে শুধু একলা আকাশ।
।।কলম।।
হয়তো
একলা
ঘরের
কোণে
বসে
শুনি
কলমের আঁচড়ের শব্দ,
দূর আকাশের বুকে লেগেছে
লালের বিপ্লব,
খানিক পরেই সূর্যের সাথে ডুববে স্বৈরাচার,
স্থাপন হবে তারার গণতন্ত্র।
যুগান্তরের অগ্রদূত এ কলম
পটু হস্তে নিয়েছে অসি-সম ক্ষিপ্রতা,
নিপুণভাবে জন রক্ত-স্রোতে জাগিয়েছে
বিপ্লবের ছন্দ,
এবার হয়তো তার বিশ্রামকাল আসন্ন,
খাপে-ভরা তরবারি হয়ে সে থেকে যাবে
ইতিহাসের পাতার আড়ালে,
কিংবা নব-যুগের নবীনদের হাতে পাবে
তাদের নতুন পরিচয়।
কেন না,
আবার এমনি কোনও বিপ্লবে
শানিত তলোয়ার রূপে
রণক্ষেত্রে ভীষণ সংঘর্ষে
তারাই পাবে অগ্রদূতের ভূমিকা।