বাড়িটা বদলেই ফেললেন রমাপদ চৌধুরী, প্রয়াত বাংলা সাহিত্যের যশম্বী সাহিত্যিক
বাংলা সাহিত্যের শেষ দার্শনিক সাহিত্যিক বললে তাঁকে অত্যুক্তি হয় না। এমনিতে সাহিত্যে দর্শনের প্রভাব থাকেই।
বাংলা সাহিত্যের শেষ দার্শনিক সাহিত্যিক বললে তাঁকে অত্যুক্তি হয় না। এমনিতে সাহিত্যে দর্শনের প্রভাব থাকেই। কিন্তু, সেই দর্শনকে গভীরভাবে মেলে ধরা আর পাঠককুলকে সেই সাহিত্যের আধারে দর্শনের গভীরে ডুব সাঁতার কাটানোটা যেন অনায়সে করাতে পারতেন রমাপদ চৌধুরী। তাই সাহিত্যের বিস্তৃত সাম্রাজ্যে সেই দর্শনের ছড়াছড়ি। সেখানে যেমন পাখা মেলেছে জীবনের মূল্যবোধ, তেমনি বিস্তার ঘটেছে সামাজিক মূল্যবোধেরও।
'বাড়ি বদলে যাই' থেকে শুরু করে 'বনপলাশীর পদাবলী', 'খারিজ', 'বীজ'-সবখানেই অনায়সে এক দর্শনকে যেন সফলভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন রমাপদ চৌধুরী। বলতে গেলে বাংলা সাহিত্যের উত্তর কল্লোলযুগের যে প্রতিনিধিরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। তাই রমাপদ চৌধুরীর প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের একটা যুগের অবসান হল বলা যেতে পারে।
প্রয়াণকালে বয়স হয়েছিল ৯৬। বহুদিন ধরেই বার্দ্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। কাউকে ঠিক করে চিনতে পারতেন না। দৃষ্টিশক্তিও কমে এসেছিল। মাঝে মাঝেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হত তাঁকে।
১৯২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর খড়গপুরে জন্ম। খড়গপুরেই স্কুলের শিক্ষা পাঠ। পরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে সাম্মানিক ইংরাজি সাহিত্যে স্নাতকস্তরের শিক্ষা নেওয়া শুরু করেন তরুণ রমাপদ। সেখান থেকেই ইংরাজি সাহিত্যে স্নাতোকত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবন শুরু আনন্দবাজার পত্রিকায়। দীর্ঘদিন রবিবাসরীয় পাতার সম্পাদনার দায়িত্ব সামলিয়েছেন তিনি। কাজের ফাঁকেই সাহিত্য রচনায় ব্রতি হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে প্রথম প্রহার-এর মাধ্যমে রমাপদ চৌধুরীর সাহিত্য প্রতিভা সকলের নজরে আসে। ১৯৬০ সালে তাঁর আরও এক সাহিত্য সৃষ্টি বিশাল রকমের প্রশংসিত হয়। আর এই সাহিত্য সৃষ্টি ছিল 'বনপলাশীর পদাবলী'। ১৯৬৯সালে 'এখনই', 'খারিজ'-ও বহুল প্রশংসা লাভ করে। ১৯৮২ সালে বাস্তবের এক কাহিনিকে অবলম্বন করে লিখে ফেলেছিলেন 'অভিমন্যু'। যা টেস্ট টিউব বেবির জনক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনি নিয়ে। পরে তপন সিনহা এই কাহিনিকে অবলম্বন করে হিন্দি-তে তৈরি 'এক ডক্টর কি মওত' নামে একটি সিনেমা। যা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি এবং তাঁর মর্মান্তিক পরিণতিকে সকলের সামনে তুলে ধরেছিল। মৃণাল সেনও 'খারিজ'-এর কাহিনিকে ঘিরে সিনেমা তৈরি করেছিলেন। ২০১৫ সালে রমাপদ চৌধুরীর শেষ লেখা প্রকাশিত হয়। এর নাম ছিল 'হারানো কথা'।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে লাং ইনফেকশনের জন্য ২০ জুলাই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। সেই হাসপাতালেই রবিবার সন্ধে ৬.৩০-এ প্রয়াত হন রমাপদ চৌধুরী। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে রেখে গিয়েছেন তিনি।
উপন্যাস থেকে ছোট গল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদ সাহিত্যে অবাধ বিচরণ ছিল রমাপদ চৌধুরীর। তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ভাবের দ্যুতিতে বিবরণকে ফুটন্ত ফুলের পাপড়ির মতো মেলে ধরা। এর সঙ্গে সুললিত ভাষা ও শব্দ-যা তাঁর লেখায় এক পৃথক স্টাইল স্টেটমেন্ট তৈরি করেছিল। যে কোনও লেখায় তিনি যে ভাবে প্রবল মুন্সিয়ানার সঙ্গে খুটিনাটি বলতেন তা তাঁর সমসাময়িক কোনও সাহিত্যিক সেভাবে ব্যবহার করেননি। মফস্বলের বেড়ে ওঠায় তাঁর লেখনি জুড়ে চোরাস্রোতের মতো যেন খেলা করত এক মেঠোয়ালি সুর।
১৯৮৮ সালে 'বাড়ি বদলে যায়'-এর জন্য পেয়েছিলেন সাহিত্য অ্যাকাডেমি সম্মান। অবশ্য সম্মান পাওয়ার এই পরম্পরা রমাপদ চৌধুরীর জীবনে শুরু হয়ে গিয়েছিল ষাটের দশকের শেষ থেকেই। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৬৩ সালে পেয়েছিলেন আনন্দ পুরস্কার, ১৯৭১ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার, ২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেমোরিয়াল ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ।
তাঁর একাধিক সাহিত্য সৃষ্টি দিশা দেখিয়েছে সিনেমা শিল্পকে। বহু বিখ্যাত পরিচালক তাঁর লেখা নিয়ে তৈরি করেছিলেন সিনেমা। ১৯৬৩ সালে 'দ্বৈপের নাম তিয়ারঙ'- পরিচালক গুরুদাস বাগচি, ১৯৭০- 'এখুনি'- পরিচালক তপন সিনহা, ১৯৭২- পিকনিক- পরিচালক ইন্দর সেন, ১৯৭৩- বনপলাশির পদাবলি- পরিচালক উত্তম কুমার, ১৯৭৪- যে যেখানে দাঁড়িয়ে- পরিচালক অগ্রগামী, ১৯৮২- খারিজ- পরিচালক মৃণাল সেন, ১৯৮৯- এক দিন অচালক- পরিচালক মৃণাল সেন, ১৯৯২- এক ডক্টর কি মওত- পরিচালক তপন সিনহা।