সাত সকালে 'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি' থেকে ফোন, ৩৫ লক্ষ টাকা প্রাপ্তির খবর, কিন্তু, সাবধান
সাতসকালেই হোয়াটসঅ্যাপ- কলে ফোন। হিন্দি-তে এক ব্যক্তি নিজের পরিচয় দিয়ে জানায় তার নাম বিজয় কুমার এবং 'ভিভো কৌন বনেগা ক্রোড়পতি' থেকে আমাকে ফোন করা হয়েছে। আমাকে ফোন করার হেতু সম্পর্কেও জানায় বিজয়।
সাতসকালেই হোয়াটসঅ্যাপ- কলে ফোন। হিন্দি-তে এক ব্যক্তি নিজের পরিচয় দিয়ে জানায় তার নাম বিজয় কুমার এবং 'ভিভো কৌন বনেগা ক্রোড়পতি' থেকে আমাকে ফোন করা হয়েছে। এমনকী আমার নাম মানে দেবজ্যোতি চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা হচ্ছে কি না তাও জানতে চায়। এরপর আমাকে ফোন করার হেতু সম্পর্কেও জানায় বিজয়। কারণ আমার কপালে নাকি নাচছে নগদ ৩৫ লক্ষ টাকার পুরস্কার। দশ হাজার ফোন নম্বর থেকে আমার নম্বরটা নাকি এই লটারিতে উঠে এসেছে। তাই সাত-সকাল এই বিপুল অর্থ প্রাপ্তির খবর দেওয়া হচ্ছে।
'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি' মানে তো সেই অমিতাভ বচ্চন! যিনি 'ফোন ইন ফ্রেন্ডে' লোকের সঙ্গে কথা বলেন। সেই ব্যারিটোন ভয়েস! যার জন্য আসমুদ্র হিমাচল পাগল হয়ে যায়। কিন্তু, অমিতাভ বচ্চন কোথায়? 'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি' থেকে এতো কোন বিজয় কুমারের ফোন। যার কথা শুনলে বোঝা যায় ইংরাজি উচ্চারণে সর্বনেশে দশা। এমন লোক 'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি'-তে! খটকা লাগে, 'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি'-র আগে 'ভিভো' বলে একটি শব্দ যোগ করেছিল বিজয়। জানতে চাই সেই 'ভিভো'-র বানান। ডাহা ফেল বিজয়। কখনও সে বলে চলে 'জিআইজিও', কখনও সে বলে 'বিআইবিও', এমনকী 'ভিভো' কীসের সংস্থা, তার উত্তরও দিতে পারেনি বিজয়।
বিজয় কোথায় থেকে ফোন করেছিল?
বিজয় কুমার-কে সরাসরি এই কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তরে বলেছিল দিল্লির চাঁদনি চক। সঙ্গে সঙ্গে বলি অফিস-এর ঠিকানা?পাল্টা তার উত্তর কেন? জানাই যে আমি দিল্লি-তেই থাকি, সুতরাং সরাসরি চাঁদনি চকে তাদের দফতরে গিয়েই বিস্তারিত জানতে চাই। সে ক্ষেত্রে সামনা-সামনি কথাও হবে এবং পরিচয়ও করা যাবে।
আঁতকে উঠেছিল বিজয়
চাঁদনি চকে তাদের দফতরে আমি যেতে চাই শোনামাত্র আঁতকে ওঠে বিজয়। সঙ্গে সঙ্গে বলতে থাকে- না, না আপনাকে এখনই আমাদের দফতরে আসতে হবে না। আপনার অর্থ আপনি বাড়িতে বসেই পেয়ে যাবেন। এমন ভান করতে থাকি, আমি নাছোড়় তাদের দফতরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু, বিজয়-এর প্রাণপ্রনে বলতে থাকে, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি ৩৫ লক্ষ টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাচ্ছি ততক্ষণ আমার বিজয়-দের দফতরে যাওয়ার দরকার নেই।
বিজয় কুমার-এর মাধ্যমে হদিস মেলে সুনীল কুমারের
কে এই সুনীল কুমার? আমি জানতে চেয়েছিলাম বিজয় কুমারের কাছে। সে বলে সুনীল-ই হল এই লটারির অর্থ পাঠানোর আসল লোক। তাহলে বিজয় কে? সে বলে তার কাজ হল লটারি প্রাপকদের সঙ্গে কথা বলে সুনীলের নম্বর দেওয়া। কারণ, কীভাবে 'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি'-র অর্থ আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হবে এবং এর জন্য আমাকে কী কী শর্ত পূরণ করতে হবে তা ওই সুনীল-ই বলবে।
সুনীলের বাড়ি কই?
বিজয় কুমার ভাবতেও পারেনি ৩৫ লক্ষ টাকার লটারি প্রাপকের কাছ থেকে এমন প্রশ্নও আসতে পারে। আমতা করে করে সে বলে সুনীলের বাড়ি কোথায় তার জানা নেই। তাহলে সুনীলকে সে চিনল কী করে? বিজয় বলে সুনীল তার বস। সুনীলকে ফোন করলেই সব জানা যাবে।
মিলল সুনীলের নম্বর
সুনীলের নম্বরও এল বিজয়ের কাছ থেকে। নম্বরটা হল ৯৮৯৯৩৭৮৭৯৮। তবে শর্ত আছে। কথা হোয়াটসঅ্যাপ কলেই হবে। এর বাইরে কল গেলে তা সুনীল রিসিভ করবে না।
এল লটারি নম্বর
তবে, সুনীলকে ফোন করলেই হবে না, তাকে একটা লটারি নম্বর দিতে হবে। বিজয় সেই লটারি নম্বরটাও আমাকে দিয়ে দেয়। লটারি নম্বরটা ছিল ০০১০২। সুনীলকে ফোন করে এই লটারি নম্বরটা বললে তবেই ৩৫ লক্ষ টাকার নগদ পুরস্কারের সিন্দুকের চাবিটা খুলবে বুঝতে পারলাম।
ক্ষিপ্ত বিজয় কুমার
এত লোক থাকতে আমাকে কেন ৩৫ লক্ষ টাকার পুরস্কার? এমন প্রশ্নে এবার বেশ রেগেই গেল বিজয়। সে জানিয়ে দেয়, কোনও লটারি প্রাপক এতটা সময় নেয়নি, যা আমি নিয়েছি। তার লেট হয়ে গিয়েছে। সুতরাং, বাকি কিছু জানতে হলে ওই সুনীলকেই ফোন করতে হবে।
কবে মিলবে পুরস্কারের অর্থ
বিজয় এবার সত্যি সত্যি অবাক করে দেয়। কারণ ও জানায় আজ দুপুরের মধ্যেই নাকি আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে যাবে ৩৫ লক্ষ টাকা। সরকারকে কর দিতে হবে না। বিজয় জানায় ও আপনি চাইলে দেবেন। না হলে কোনও দরকার নেই। পুরো ৩৫ লক্ষ টাকাই নাকি আমার জন্য। মনে মনে বলেই ফেলি হায় সরকারটা যদি এই বিজয়-এর মতো ভাবতো তাহলে আমাদের অনেকগুলো টাকা বেঁচে যেত। যাইহোক এবার ফোন কেটে দেয় বিজয়।
পাকিস্তান থেকে এসেছিল ফোন?
বিজয় কুমারের এমন অদ্ভুত ফোনের ঘোর কাটিয়ে নেমে পড়তে হল অন্তর্তদন্তে। হোয়াটসঅ্যাপ কলে থাকা বিজয়-এর নম্বর দেখে বোঝা গেল ফোনটা পাকিস্তানের আইএসডি কোড-এর মাধ্যমে এসেছে। কারণ, ভারতের আইএসডি কোড যেমন +৯১, তেমনি পাকিস্তানের আইএসডি কোড +৯২। সুতরাং, সন্দেহ নেই বিজয় কুমারের মতো প্রতারক যারা তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে সাইবার রবারি করে তারা পাকিস্তানের নম্বরের সাহায্য নিয়েছে। তবে সত্যি সত্যি বিজয় কুমার পাকিস্তানে বসে ফোন করেছিল এমনটা বলা যায় না। কারণ, এখন এমন প্রযুক্তিও বের হয়েছে যাতে এক দেশে বেশে অন্য দেশের আইএসডি কোড হ্যাক করেও ফোন করা যায়।
'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি'-র নামে বিশাল প্রতারণার চক্র
এবার নেট দুনিয়ায় এই প্রতারক দলের সম্পর্কে খোঁজ-খবর শুরু করতেই বেরিয়ে আসে একের পর এক তথ্য। দেখা যায় বহু অনলাইন মিডিয়াই বহু দিন থেকে 'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি'-র নামে এই প্রতারণা চক্রের পর্দা ফাঁস করেছে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যের বিষয় এই প্রতারণা চক্রের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনও সাফল্য আসেনি। এমনকী, খোদ 'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি' এই প্রতারণা চক্রের বিরুদ্ধে যে কোনও অভিযোগ পুলিশ-এর কাছে দায়ের করেছে এমন তথ্যও পাওয়া যায়নি। 'কৌন বনেগা ক্রোড়়পতি'-র প্রোডাকশন টিমের প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়, কিন্তু, তা সফল হয়নি।
সাবধান হোন
শুধু 'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি'-র নামে এমন প্রতারণা চক্র সক্রিয় তা নয়। নানা ফন্দি-ফিকির করে নানাভাবে ফোনে প্রতারকরা ডেবিট কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড-এর নম্বর ও পিন চেয়ে নিচ্ছে, আর মুহূর্তে অ্যাকাউন্ট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে অর্থ। কেউ ইতিমধ্যেই খুঁইয়েছেন হাজার-হাজার টাকা, কেউ আবার লক্ষ লক্ষ টাকার এমন প্রতারণার শিকার। তাই, মাথার মধ্যে সকলেরই ঢুকিয়ে নেওয়া ভালো এমন ফোন এলে তা যতই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হোক তাতে সাড়া না দেওয়া। প্রয়োজনে ব্যাঙ্কে সশরীরে গিয়ে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য নিজের হাতে কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়াটাই ভালো।
ফোন ছাড়াও এসএমএস, ইমেল
ফোন ছাড়াও এমন প্রতারকরা ফাঁদ পাতে এমএসএস-এর মাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়াতেও মেসেজ বক্সে চলে আসে লোভনীয় সব অফার। এমনকী ই-মেল করা হয়। তাই সন্দেহজনক কিছু দেখলে তাকে ওপেন না করেই ডিলিট করে দিন।
ফোন নম্বর ব্লক করে, রিস্টার্ট দিন
এমন প্রতারক বা সন্দেহজনক ফোন পেলে সঙ্গে সঙ্গে তা ব্লক করে দিন এবং ফোন রিস্টার্ট করুন। হোয়াটসঅ্যাপ কলে ফোন এলে সেখানেও নম্বর ব্লক করুন ও হোয়াটসঅ্য়াপ আনইনস্টল করে নতুন করে তা ইনস্টল করুন। অনলাইন ট্রান্সাকশনের ক্ষেত্রে খুবই বিশ্বাসযোগ্য পেমেন্ট-গেটওয়ে ছাড়া কার্ড সোয়াইপ করবেন না। অনলাইনে খাবার অর্ডার করলেও চেষ্টা করুন নগদে বিল মেটানোর বা তাদের বলুন কার্ড-সোয়াইপ মেশিন ক্যারি করতে।