মার্চের মধ্যেই চলে যাবে চাকরি! 'অসহযোগ আন্দোলনে' এইচএসসিএল-এর ৭ হাজার চুক্তিভিত্তিক কর্মী
এইচএসসিএল-এর অবলুপ্তিতে কাজ হারানোর আশঙ্কা অন্তত ৭ হাজার চুক্তিভিক্তিক কর্মী। যার জেরে দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলনে নেমেছেন তাঁরা।
চলতি আর্থিক বছরের শেষেই পুরোপুরি অবলুপ্তি ঘটে যাচ্ছে হিন্দুস্তান স্টিল ওয়ার্কস অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড বা এইচএসসিএল-এর। পরিকাঠোমা তৈরির ক্ষেত্রে সরকারি এই সংস্থা একটা সময় দেশের অন্যতম অগ্রণী সংস্থা ছিল। কিন্তু, নরেন্দ্র মোদী সরকার ২০১৬ সালে এইচএসসিএল-কে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ নবরত্ন সংস্থা ন্যাশনাল বিল্ডিংস কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন বা এনবিসিসি-র সঙ্গে মিশিয়ের দেওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিলমোহর দেয়। যার ফলে এখন কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কায় দিন গুনছেন এইচএসসিএল-এর চুক্তিভিত্তিক হাজার সাতেক কর্মী। এরমধ্যে এইচসিএল-এর সঙ্গে সরাসরি চুক্তি-তে রয়েছেন ৬০০ কর্মী। বাকিরা রয়েছেন কোনও এজেন্সি বা ঠিকাদার সংস্থার মাধ্যমে।
এইচএসসিএল-এর কর্মীদের দাবি, এনবিসিসি থেকে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে চলতি আর্থিক বছরের শেষ হতেই তাঁদের চাকরির চলে যাওয়ার কথা। এর ফলে এখন নিত্যদিন আশঙ্কা আর উৎকন্ঠায় দিন কাঠছে এইচএসসিএল-এর এই চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের। এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে গত ৫ দিন ধরে দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলনে নেমে পড়েছেন এইচএসসিএল-এর চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা। যার মধ্যে রয়েছেন সরাসরি এইচএসসিএল-এর অধীনে থাকা ৬০০ চুক্তি ভিক্তিক কর্মীও।
ভিলাই থেকে রৌরকেল্লা, রাঁচি- সর্বত্রই অসহযোগ আন্দোলনে নেমে পড়েছেন চুক্তিভিক্তিক কর্মীরা। যার জেরে গত কয়েক দিন ধরেই দেশ জুড়ে কম করেও শতাধিক প্রজেক্টেও কাজ বন্ধ আছে। ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বন্ধ রয়েছে। এই রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এইএসসিএল-এর কাঁধেই। এমনকী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একাধিক প্রকল্পেও এর ফলে কাজ বন্ধ রয়েছে। কারণ, এই সব প্রকল্পে পরিকাঠামো তৈরির কাজ করছে এইচএসসিএল। সংস্থার সঙ্গে সরাসরি চুক্তিতে থাকা ৬০০ কর্মীর অভিযোগ, কলকাতায় এইচএসসিএল-এর সদর দফতরই নয়, মুম্বই, দিল্লি, গুয়াহাটি সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা এইচএসসিএল-এর সমস্ত দফতর এনবিসিসি-র হাতে চলে যাবে।
১৯৬৪ সালে জন্ম হয়েছিল হিন্দুস্তান স্টিল ওয়ার্কস অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড বা এইচএসসিএল-এর। জন্ম থেকেই এর সদর দফতর কলকাতার হেস্টিংসে। প্রথমাবস্থায় সরকারের ইস্পাত তৈরির কারখানার পরিকাঠামো তৈরিতে মনোনিবেশ করত ভারত সরকারের এই সংস্থা। পরে সিভিল কনস্ট্রাকশনের পরিকাঠামো তৈরিতেও এই সংস্থার কাজকে বিস্তার করানো হয়। ১৯৭৯ সালের মধ্যে এইএসসিএল-এর কর্মীসংখ্যা ২৬,৫৩৭-এ গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু, আয়ের তুলনায় দায়ভার বেড়ে যাওয়ায় খুব দ্রুত ক্ষতির মুখ দেখতে শুরু করে এইএসসিএল। ভিআরএস-এর মাধ্যমে নয়ের দশকে বহু কর্মীকে সংস্থা থেকে বের করা হয়। সংস্থার পুনর্গঠনের জন্য ২০০৫ সাল থেকে চুক্তিভিক্তিক কর্মী নিতে শুরু করে এইচএসসিএল। ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে অ্যাকাউন্টস, এইচআর, মার্কেটিং-সহ আরও নানা বিভাগ মিলিয়ে ২০১২ সালে সরাসরি এইচএসসিএল-এর সঙ্গে চুক্তি থাকা কর্মী সংখ্যা পৌঁছেছিলো ১৩০০-তে। কিন্তু, সম্প্রতি বহু কর্মীর চুক্তি নবীকরণ না হওয়ায় এই মুহূর্তে এইচএসসিএল-এর সঙ্গে সরাসরি চুক্তিতে থাকা কর্মী সংখ্যা ৬০০-তে নেমে দাঁড়িয়েছে।
এই ৬০০ কর্মীদের দাবি, চুক্তিভিত্তিক শুধু নয়, নামমাত্র মাইনতে দিনের পর দিন কাজ করেও তাঁরা ২০১৫-১৬ সালের আর্থিক বর্ষে এইচএসসিএল-কে ৩০.১৯ কোটি টাকার লাভের মুখে দেখিয়েছেন। গত ৩০ বছরে এইচএসসিএল এত পরিমাণ মুনাফার মুখই দেখেনি। অসহযোগ আন্দোলন চালানো চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের অভিযোগ, সংস্থার মার্জার নিয়ে প্রথম থেকেই তাঁদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা হয়েছে। ২০১৬ সালে মোদী সরকার যখন এইচএসসিএল-কে এনবিসিসি-র সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিল তখনও তাঁদের ঘূণাক্ষরে জানানো হয়নি যে তাঁরা কাজ হারাতে চলেছেন। সম্প্রতি এইচএসসিএল-এর সমস্ত ধরনের পরিচালনার দায়িত্ব নিতে শুরু করেছে এনবিসিসি। আর তারপরই সপ্তাহখানেক আগে এনবিসিসি থেকে নোটিস দিয়ে চুক্তিভিক্তিক কর্মীদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে চলতি আর্থিক বর্ষের শেষে আর তাঁদের কাজে আসতে হবে না।
বর্তমানে এইচএসসিএল-এর স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ৩০। এঁদের নিরানব্বই শতাংশই এক থেকে দু'বছরের মধ্যে অবসর নেবেন। অসহযোগ আন্দোলনে নামা চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের দাবি, ২০০৫ সাল থেকেই তাঁরা এই সংস্থাকে টেনে নিয়ে চলছেন। সংস্থার আর্থিক হালও এখন পর্যন্ত বেশ ভাল। তবে ১৯৯৯ সালে সংস্থার পুনরুজ্জীবনের জন্য বিশাল অঙ্কের ঋণ নেওয়া হয়েছিল তার দায় মেটাতেই সংস্থার হাঁসফাস অবস্থা। কিন্তু, এই ঋণের দোহাই তুলে একদিকে যেমন এইচএসসিএল-এর অবলুপ্তি ঘটানো হচ্ছে, তেমনি তাঁর কর্মীদেরও বঞ্চিত করা হচ্ছে।
সরকারি সংস্থার নিরাপদ চাকরির কথা ভেবে বহু কৃতী ছাত্রই অল্প মাইনেতেই এইচএসসিএল-এর চুক্তি ভিক্তিক চাকরিতে নাম লিখিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে অনেকেরই বয়স হয়েছে। এমনকী সংসারও রয়েছে। এই মধ্য বয়সে কাজ হারালে আর কোথায় চাকরি পাবেন এই ভেবেই কোনও কুল-কিনারা পাচ্ছেন না এই সব কর্মীরা।
দফায় দফায় সংস্থার পরিচালন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেও কোনও লাভ হয়নি। ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলার প্রতিনিধিও এই সংবাদ সংগ্রহের জন্য এইচএসসিএল-এর এমডি মযূখ ভাদুড়ির সঙ্গে দেখা করতে যান। কিন্তু কার্যত দুর্ব্যবহার করে তাঁকেও তাড়িয়ে দেন এমডি-র ব্যক্তিগত সহায়ক এস মাইতি।
এমতাবস্থায় বুধবার কলকাতায় এইচএসসিএল-এর সদর দফতরে আসেন শিল্প মন্ত্রকের এক মহিলা প্রতিনিধি। সূত্রের খবর, তিনি চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের ভাল করে কাজ করার পরামর্শ দিলেও চলতি আর্থিক বছরের শেষে তাঁদের চাকরি থাকবে কি না তা নিয়ে কোনও আশ্বাসই দেননি। আন্দোলনে নামা কর্মীদের অভিযোগ, এনবিসিসি-র পক্ষ থেকেও নিয়মিত তাঁদের হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলন প্রত্যাহার না করলে 'অন দ্য স্পট' চাকরি কেড়ে নেওয়া হবে বলেও শাসানি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। শেষমুহূর্তে মোদী সরকার কর্মীদের স্বার্থে কোনও সিদ্ধান্ত জানায় কি না তার দিকেই এখন তাকিয়ে কাজ হারাতে চলা এই সব কর্মীরা।