সিনেমা দেখেই কসবায় খুনের ছক শম্ভু ও তার সঙ্গীর! আর যা বলছে কলকাতা পুলিশ
সিনেমা দেখে খুনের ও প্রমাণ লোপাটের ছক সাজিয়েছিল সদ্য কৈশোর পেরনো দুই আততায়ী। শম্ভু কয়াল ও রাকেশ। টাকার লোভ দেখিয়ে আনা হয়েছিল রাকেশকে।
সিনেমা দেখে খুনের ও প্রমাণ লোপাটের ছক সাজিয়েছিল সদ্য কৈশোর পেরনো দুই আততায়ী। শম্ভু কয়াল ও তার একবন্ধু। টাকার লোভ দেখিয়ে আনা হয়েছিল ওই বন্ধুকে। কসবার টেগোর পার্কে শীলা চৌধুরীর হত্যাকাণ্ডের কিনারা করার পর এমনটাই জানিয়েছে কলকাতা পুলিশ। পরিকল্পনা খেটে গেলেই বোঝা সম্ভব হত না, ঘটনাটি খুন না দুর্ঘটনা।
কলকাতা পুলিশের তরফে ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিবরণ দেওয়া হয়েছে। শনিবার, ৯ জুন তারিখ, কসবা থানায় বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মধ্যবয়স্কা এক মহিলার অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর আসে। ঘটনাস্থল টেগোর পার্কের একটি ফ্ল্যাট।
পুলিশের তরফে বর্ণনায় বলা হয়েছে, ঘরের মেঝেতে মহিলার প্রাণহীন দেহ চিৎ হয়ে পড়ে। পরনে ঘরের পোশাক। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ সংস্থা ন্যাটমোর উচ্চ পদাধিকারী। বিবাহবিচ্ছিন্না শীলা দেবী ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন। মৃতার মাথার পিছনের ক্ষতস্থানে চাপ চাপ রক্ত। গালে-ঘাড়ে-থুতনিতে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মেঝের বেশ কিছু জায়গায় রক্তের ছাপ।
মৃতদেহের পাশেই রবারের পাইপ লাগানো একটা গ্যাস সিলিন্ডার ও ওভেন রাখা। গ্যাস সিলিন্ডারের নবের সঙ্গে একটা দড়ি বাঁধা। সেই দড়ির ছেঁড়া অংশ ব্যালকনি দিয়ে নিচে ঝুলছে। দরজার মুখে ছড়ানো-ছিটোনো রয়েছে কিছু পোড়া কাপড়। স্পষ্টতই, ঘরে আগুন লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু মৃতদেহের কোথাও পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন নেই।
ফ্ল্যাটের দক্ষিণের সমস্ত জিনিস তছনছ অবস্থায় পড়ে। দেখেই বোঝা যায়, অপরাধীরা বেপরোয়া ভঙ্গিতে কিছু খুঁজেছে। স্টিল আলমারির লকার ভাঙা। নগদ টাকার চিহ্নমাত্র নেই। ভিতরের জিনিসপত্র ওলটপালট। গয়নার বাক্স খালি।
ফ্ল্যাট থেকে রক্তের নমুনা, আঙুলের ছাপ সহ সমস্ত প্রয়োজনীয় প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়। শীলা চৌধুরীর প্রাক্তন স্বামী বর্তমানে জীবিত নেই। বাকি আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে প্রতিবেশী, বন্ধু, পরিচারকদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। জেরায় প্রাথমিকভাবে সামান্যতম কোনও সূত্র মেলেনি। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, শীলা চৌধুরী হাসিখুশি, নির্বিরোধী মানুষ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কারও শত্রুতার খবর নেই।
তাহলে ব্যক্তিগত আক্রোশ, সম্পর্কজনিত জটিলতা, না স্রেফ ডাকাতি ?
ম্যারাথন জেরায় অবশেষে সূত্র পাওয়া যায়। একজনের বয়ান ও আচরণে অসঙ্গতি ধরা পড়ে যথেষ্টই। সে হল ফ্ল্যাটের সাফাইকর্মী শম্ভু কয়াল। বয়স মাত্র ১৯। শুরুতে নানাভাবে বিপথে চালিত করার চেষ্টা করলেও জেরার মুখে শেষমেষ যে কবুল করে অপরাধ। সে জানায়, সে এবং তার সঙ্গী ( বয়স বছর ১৫-র আশপাশে) মিলে শীলা চৌধুরীকে খুন করেছে। উদ্দেশ্য, শীলা চৌধুরীর টাকা-গয়না হাতানো। শম্ভুর সঙ্গে তার বন্ধুকেও গ্রেফতার করা হয়।
কীভাবে খুন?
কিছুদিন
আগে
চাকরি
পাওয়ার
আশায়
একটি
ভুয়ো
সংস্থার
খপ্পরে
পড়ে
২৩০০০
টাকা
খুইয়েছে
শম্ভু।
পরিবার
দুঃস্থ,
টানাটানির
সংসার
।নিজে
সবে
উচ্চমাধ্যমিক
পাশ
করেছে।
টাকা
পরিবারের
থেকেই
ধার
নিয়েছিল
এবং
তা
ফিরিয়ে
দেওয়ার
চাপও
ছিল।
ফ্ল্যাটের
সাফাইয়ের
কাজে
কতই
বা
মাইনে।
এত
টাকা
দ্রুত
হাতে
আসা
ছিল
অসম্ভবই।
সাফাইয়ের কাজ করার পাশাপাশি শীলা চৌধুরীর বাজার করে দিত শম্ভু, মাল বয়ে দিত। সে শীলা চৌধুরীর কাছে ধারই চায় প্রথমে। তিনি ধার দিতে রাজি হননি। শম্ভুর রাগ চেপে যায়। সে ঠিক করে, শীলা চৌধুরীকে খুন করে টাকা ও গয়নাগাটি হাতাবে। টাকার লোভ দেখিয়ে শম্ভু জুটিয়ে নেয় তারই বন্ধুকে। তার বয়স ১৫। তার মা কদিন আগে শীলা দেবীর ফ্ল্যাটে পরিচারিকা ছিলেন। সে-ও শীলা দেবীর পরিচিত। এরপর দু'জনে মিলে খুনের ছক কষা।
ছক রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। খুনের দিন শম্ভু পরিকল্পনামাফিক বাজারের ব্যাগ হাতে শীলা দেবীর ফ্ল্যাটে ঢোকে। এই সময়ে শীলা দেবীকে অন্য কাজে ব্যস্ত রেখে বন্ধুকেও ঘরে ঢুকিয়ে নেয় এবং বলে খাটের তলায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকতে। বন্ধুও যেহেতু এই ফ্ল্যাটের অন্যান্য বাসিন্দাদের কাছে পূর্বপরিচিত, ফ্ল্যাটে ঢুকতে কোনও সমস্যা হয়নি। সে নিঃশব্দে শীলা দেবীর ঘরে ঢুকে অপেক্ষা করতে থাকে।
এরপর শীলা দেবী তাঁর শোওয়ার ঘরে ঢুকতেই বন্ধুই পা ধরে টেনে তাঁকে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর দুজনে মিলে একটা মোটা কড়াই দিয়ে শীলা দেবীর মাথার পিছনে বারবার আঘাত করে। এই অবস্থাতেই মৃতপ্রায় শীলা দেবীকে টেনে রান্নাঘরের পাশের ঘরে নিয়ে আসে দুজন। তারপর মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন এবং ঘর থেকে নগদ ৭৫০০ টাকা ও গয়নাগাটি লোপাট।
এখানেই শেষ নয়। খুনের কোনও প্রমাণ যাতে না থাকে, সে প্ল্যানও তৈরি ছিল, হিন্দি সিনেমার স্টাইলে । গ্যাস সিলিন্ডারের নবের সঙ্গে একটা দড়ি বেঁধে সেটা ব্যালকনি দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিল দু'জনে। এরপর মৃতদেহের পাশে জামাকাপড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
পরিকল্পনা, গোটা ঘটনাকে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে অগ্নিসংযোগে মৃত্যুর মোড়ক দেওয়া। তাই সিলিন্ডারের নবে দড়ি বেঁধে নিচে ঝুলিয়ে দেওয়ার প্ল্যান। ধীরে সুস্থে নিচে নেমে দড়ি ধরে টান মারলেই নব খুলে সিলিন্ডারের গ্যাস বেরোতে থাকবে। ঘরে মৃতদেহের পাশে কাপড়ে আগুন জ্বলছিলই। ফলে গ্যাস বেরোলে দ্রুত সিলিন্ডার ফেটে গোটা ঘরই চলে যাবে আগুনের গ্রাসে। মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে সমস্ত প্রমাণও। তবে শেষরক্ষা হয়নি টানতে গিয়ে দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ায়।
কসবা থানার যেসব অফিসার খুনের রহস্যভেদে সাহায্য করেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া হয়েছে তাদের ছবিও। বাঁদিক থেকে দাঁড়িয়ে, সার্জেন্ট সৌমিত সেন, এসআই প্রসেনজিৎ নস্কর, প্রেমশঙ্কর ওঝা, শীলভদ্র ঘোষ, শুভঙ্কর দাস। বাঁদিক থেকে বসে, অতিরিক্ত ওসি জগন্নাথ মন্ডল এবং ওসি দেবাশিস দত্ত।