একটা দুর্ঘটনা, ৩৫ মিনিটের মিসিং লিঙ্কে স্বপ্নের সমাপ্তি, নাড়া দিয়ে গেল ২০১৭-য়
গতির প্রেমে ভেসে গিয়ে একটা ছোট্ট ভুল। আর তাতেই সব শেষ। শেষ একটা স্বপ্নের। শেষ একটা বিশ্বাসের। মাঝে ৩৫ মিনিটের একটা মিসিং লিঙ্ক। তা ঘিরেই যত সন্দেহ, বিতর্ক।
গতির প্রেমে ভেসে গিয়ে একটা ছোট্ট ভুল। আর তাতেই সব শেষ। শেষ একটা স্বপ্নের। শেষ একটা বিশ্বাসের। মাঝে ৩৫ মিনিটের একটা মিসিং লিঙ্ক। তা ঘিরেই যত সন্দেহ, বিতর্ক। অবশেষে মডেল-বান্ধবী সনিকা চৌহানের মৃত্যুতে শ্রীঘরে ঠাঁই অভিনেতা-বন্ধু বিক্রম চট্টোপাধ্যায়ের। ২০১৭-য় এই একটা দুর্ঘটনা নিয়েই কম নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়নি। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। যার জেরে দু-ভাগ হয়ে গিয়েছিল টলিউডও। এক ঝলকে ফিরে দেখা সেই ঘটনা।
গতির বলি মডেল, ট্রমায় অভিনেতা
২৯ এপ্রিল ভোররাত। বিক্রমের গাড়িতে করে ফিরছিলেন মডেল বান্ধবী সনিকা। রাসবিহারী মোড়ের সামনে একটি গাড়িকে বাঁচাতে গিয়ে ডিভাইডারে ধাক্কা লাগে বিক্রমের গাড়ির। বেপরোয়া গতির কারণে সামলাতে পারেননি বিক্রম। ছিটকে পড়ে গাড়ি। অত্যাধুনিক গাড়ির স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাও কাজ করেনি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু মডেল সনিকা সিং চৌহানের। চোখের সামনে বান্ধবীকে শেষ হয়ে যেতে দেখে পলিট্রমায় আক্রান্ত বিক্রম চট্টোপাধ্যায়।
মদ খেয়েছিলাম, মত্ত ছিলাম না
প্রশ্ন ওঠে বিক্রম মদ্যপ অবস্থায় স্টিয়ারিংয়ে ছিলেন। তাই বেপরোয়া গাড়িকে বাগে আনতে পারেননি। ছিটকে পড়েছিল গাড়ি। ফাঁকা রাস্তায় গতিও ১০০ কিলোমিটারের ঊর্ধ্বে ছিল বলে দাবি করেছিলেন তদন্তকারী আধিকারিকরা। বিক্রম সুস্থ হওয়ার পর জেরা শুরু। ফরেনসিক তদন্ত, কেন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা কাজ করল না, তা জানতে বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষা হল। গাড়ির ভিতরে মিলল মদের বোতল। বন্ধুদের বয়ানও গেল বিক্রমের বিরুদ্ধে। ফলে কোণঠাসা বিক্রম গ্রেফতার হলেন। গোটা প্রক্রিয়ায় লাগল প্রায় আড়াই মাস। ২৯ এপ্রিলের ঘটনায় বিক্রম গ্রেফতার হলেন ৭ জুলাই।
৩৫ মিনিটের মিসিং লিঙ্কেই ছিল রহস্য ঘণীভূত
দুর্ঘটনার পরই প্রশ্ন উঠে যায়- গাড়িতে ৩৫ মিনিট কী করছিলেন বিক্রম ও সনিকা? ওই ৩৫ মিনিটের মিসিং লিঙ্কের জট খুলে গেলেই রহস্য কেটে যাবে। সনিকা মৃত্যু রহস্যের কিনারাও হয়ে যাবে। সেই রহস্যভেদেই তদন্তকারী সিটের কাছে উঠে আসে একগুচ্ছ প্রশ্ন। আর তা জানতেই ২৫ জনের নামের তালিকা তৈরি করে ফেলে সিট। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা চালান তদন্তকারীরা।
সনিকার মৃত্যু রহস্যের কিনারায়
পুলিশ জানার চেষ্টা চালায়, ওইদিন রাতে পার্টি থেকে বেরিয়ে সনিকাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার আগে সনিকাকে নিয়ে ওয়াটগঞ্জে না গিয়ে সম্পূর্ণ উল্টোদিকে নিজের ফ্ল্যাটে কেন গিয়েছিলেন বিক্রম? আবার নিজের ফ্ল্যাটের কাছে গিয়েও কেন ঢুকলেন না ভিতরে? কেনই বা তিনি সনিকাকে নিয়ে গাড়িতেই বসে রইলেন? তাহলে গাড়ির ভিতরে ওই দীর্ঘ সময় কী করছিলেন তাঁরা?
কেন বাদানুবাদ, হাতাহাতি!
বিক্রম পুলিশকে জানিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বাদানুবাদ চলছিল। এমনকী হাতাহাতিতেও জড়িয়ে পড়ে তাঁরা। তাহলে কি গাড়ির মধ্যেই মতানৈক্যের এই বহিঃপ্রকাশের জেরেই দুর্ঘটনা? নাকি আরও কিছু ঘটেছিল ওই রাতে? কেননা পুলিশ কিছুতেই মানতে পারছে না, শুধু গাড়ির চাকা স্কিড করে এই দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। হয় গাড়ির গতি অনেক বেশি ছিল, নতুবা এমন কিছু ঘটেছিল, বিক্রম নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরেই মুহূর্তের অসতর্কতায় ঘটিয়ে ফেলেছে দুর্ঘটনা।
ত্রিকোণ প্রেমের তত্ত্বে দুর্ঘটনার তদন্তে মোড়
পুলিশের জিজ্ঞাস্য ছিল, গাড়ির মধ্যে কী নিয়ে মতানৈক্য তৈরি হয়েছিল? কেন তাঁরা জড়িয়ে পড়েছিলেন বাদানুবাদ ও হাতাহাতিতে। পুলিশের কাছে বিক্রম দাবি করে গত চারমাস ধরে তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সনিকা সাহেবের বাদদত্তা বলে টলিউডে প্রচার ছিল। সেই সাহেবের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে নাকি বেরিয়ে এসেছিলেন সনিকা। তিনি নাকি মুম্বইয়ে সেটল হতে চাইছিলেন। তা নিয়েই বিবাদ। বিক্রম চাইছিলেন সনিকা কলকাতাতেই থাকুন। বিক্রমের এই যুক্তি বা দাবি কতখানি সত্য, তা নিরূপণ করতে নামেন তদন্তকারীরা।
পার্টিতে উপস্থিত কমন ফ্রেন্ডের বয়ানেই ভরসা
বিক্রম ও সনিকা দুর্ঘটনার রাতে একসঙ্গেই ছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন। পার্টিতে অংশ নিয়েছেন। সেখানে বিক্রম-সনিকার তিন বান্ধবী ও চার বন্ধু উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের বয়ান রেকর্ড করে এবং আদালতে গোপন জবানবন্দে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করা বান্ধবীদের বয়ানের ভিত্তিতেই বিক্রমকে গ্রেফতার করা হয়। যে ক্যাবে করে সনিকাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন বিক্রম তার চালক, দু-তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী, বারটেন্ডারদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারীরা।
২৯ এপ্রিল দুঃস্বপ্নের রাত বিক্রমের!
তারপর বিক্রমের গাড়ি পুনরায় ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়। কেন এয়ারব্যাগ খুলল না, সিট বেল্ট বাঁধা হয়েছিল কি না, গাড়ির গতি কত ছিল, চাকা স্কিড করেছিল বলে বিক্রমের দাবি, তা সঠিক কি না- সবকিছুই রিপোর্ট হাতে নিয়ে পুলিশ গ্রেফতার করে তাঁকে। অবশেষে জেলমুক্তির পর মানসিক দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ফের নিজেকে কাজে ডুবিয়ে আঘাত ভোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অভিনেতা বিক্রম। সনিকা নেই, চোখ বুজলেই হয়তো আজও বিক্রমের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে ২৯ এপ্রিলের রাত।