'গুলি করে নগ্ন দেহটাকে ঝুলিয়ে ভিডিও কর', পড়ুন কলকাতার বুকে নিগৃহীত চিত্রসাংবাদিকের বয়ান
প্রথমে মার। তাতেও সন্তুষ্টি আসেনি। তারপর এক্কেবারে অপহরণ। এ যেন বঁড়শিতে মাছ গেঁথে ফেলার মতো আনন্দে বিভোর অপহরণকারীরা।
প্রথমে মার। তাতেও সন্তুষ্টি আসেনি। তারপর এক্কেবারে অপহরণ। এ যেন বঁড়শিতে মাছ গেঁথে ফেলার মতো আনন্দে বিভোর অপহরণকারীরা। আহা! যে কাজে তারা সকাল থেকে লেগেছিল তাতে যে 'অ্য়াকশন'- হচ্ছিল তা বেশ সংগঠিত। কিন্তু, চাঁদা করে করে শিকারকে পেড়ে ফেলাটা তো হচ্ছিল না। ধুস এতে কোনও আনন্দ আছে নাকি! কারণ, ভয়ে তো বিরোধী দলের কেউ আলিপুর ট্রেজারি বিল্ডিং-এর চক্রবূহ্যে পা-ই মাড়াচ্ছিল না। আর সেই চক্রবূহ্যে নাকি সাংবাদিক! এ আর সহ্য করা যায়। এতে যেচে শিকার হওয়ার মতো ঘটনা।
[আরও পড়ুন:শহরে চিত্র সাংবাদিককে নগ্ন করে নিগ্রহ, কতটা আতঙ্কে কলকাতার মহিলা সাংবাদিকরা ]
সোমবার আলিপুর ট্রেজারি বিল্ডিং-এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের জামানায় সবচেয়ে বড় সাংবাদিক নিগ্রহের যে ঘটনা ঘটে গিয়েছে তা নিয়ে কথা হচ্ছিল নিগৃহীত চিত্র সাংবাদিকের সঙ্গে। ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলার সঙ্গে কথোপকথনে তিনি যে ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন তা শুধু নক্কারজনকই নয়, সেই সঙ্গে রাজ্যের বর্তমান শাসকদলের ভাবমূর্তিকে ধাক্কা দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। সোমবার ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে? কীভাবে ঘটল ঘটনা? তার পুরো বিবরণই দিয়েছেন নিগৃহীত চিত্র সাংবাদিক।
'সোমবার সকালে তারাতলার কাছে একটি অ্যাসাইনমেন্টের মধ্যেই খবর আসে আলিপুর কোর্টের পঞ্চায়েত মনোনয়ন জমাকে কেন্দ্র করে গণ্ডগোল হতে পারে। আলিপুর আদালতের বাইরে জল কামান থেকে বিশাল পুলিশ বাহিনীও মোতায়েন করা হয়েছে। অফিসের নির্দেশে দ্রুত ছুটি আলিপুর আদালতে। পৌঁছে দেখতে পাই প্রচুর লোক আদালতের গেট অবরোধ করে রেখেছে। ওরই মধ্যে ফাঁক গলে ভিতরে প্রবেশ করি। কারণ নবপ্রশাসনিক ভবনে মনোননয়ন জমা চলছিল।দেখতে পাই এসডিও অফিসে যারাই ঢোকাচর চেষ্টা করছে তাদের সমস্ত কাগজপত্র এবং শরীর জুড়ে তল্লাশি করছে একদল লোক। এদের মধ্যে যাদের কাছে মনোনয়নপত্র পাওয়া যাচ্ছে তাদেরকে মারধর করা হচ্ছে এবং মনোনয়নপত্র ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এমনকী, মাটিতে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। এই ঘটনার ছবি ক্য়ামেরা দিয়ে তোলা যাবে না দেখে মোবাইলে কয়েককটি স্ন্য়াপ নিয়ে নি। এরপর ওই ভিড় ঠেলে আর একটু এগোতেই বিপত্তি। আমাকে কয়েক জন ধরে ফেলে। আমার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়। আমি সাংবাদিক পরিচয় দিতেই শুরু হয়ে যায় মারধর। কিল, চড়, ঘুষ থেকে শুরু করে লাথি - কিছুই বাদ ছিল না।
আমাকে জোর করে মোবাইলের লক খোলানো হয়। ওরা সমস্ত ছবি ডিলিট করে দেয়। এরপর বেশকিছুক্ষণ আমাকে মাটিতে বসিয়ে রাখে। কিছুপরে আরও একদল নতুন লোক এসে আমাকে কলার ধরে টানতে টানতে প্রশাসনিক ভবনের পিছন দিক দিয়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের পিছনে থাকা ওয়াচ টাওয়ারের পাশের একটি বস্তিতে নিয়ে আসা হয় (এখান থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি হাফ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে)। সেখানে একটি দরমা দেওয়া ঘরে আমাকে দফায় দফায় মারধর করে। সেই সঙ্গে চলতে থাকে হুমকি। বলা হয়,- তোর বড় সাহস বেড়েছে, তোদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে, এমন সব কথা বলা হয়। আমার ব্যাগ সার্চ করা হয়। পেন ড্রাইভ পর্যন্ত নিয়ে নেয়। মানি ব্যাগ সার্চ করা হয়। ব্য়াগের ভিতরে স্টিল ক্য়ামেরা দেখে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে যায় হামলাকারীরা। অনেক কস্টে বোঝাই ক্য়ামেরায় ব্য়াটারি লাগানো নেই। তাই তা দিয়ে ছবি তোলা অসম্ভব। ওরা আবার মোবাইলটা নিয়ে নেয়। বলে হোয়াটস অ্য়াপ-এ নাকি ছবি অফিসে পাঠিয়েছি। এরমধ্যে আরও ৪-৫ জন আসে। বলে- তোদের বহুত বাড় বেড়েছে। এবার তোকে ন্য়াংটো করে ছবি তুলব এবং তা ডেস্ক, ল্য়াপটপ, ইন্টারনেটে ছেড়ে দেব। আমার প্রবল তেষ্টা পেয়েছিল, জল চাই, কিন্তু দেয়নি। শেষমেশ বস্তির অন্য ঘর থেকে এক বয়স্ক জল এনে খাওয়ায়। ইতিমধ্যে তণমূল কংগ্রেসের আরএকটি দল জলের বোতল নিয়ে আসে। কিন্তু, মারমুখী দলের ভাবমূর্তি দেখে ওরা চম্পট দেয়। ওরা জোর করে আমার জামা খুলতে থাকে। বোতাম ছিড়ে দেয়। শেষমেশ আমি নিজেই জামার নিচের শেষ দুটি বোতাম খুলি। এরপর প্য়ান্ট খুলতে বলে। আটকানোর চেষ্টা করি। লাভ হয়নি। জোর করে বেল্ট খুলে দেয়। প্যান্ট খুলে ফেলার জন্য জুতো খোলায়। এরপর প্যান্ট খুলে নেয়। খালি গায়ে শুধুমাত্র কোমরের অন্তর্বাস পরে আমি তখন দাঁড়িয়ে। ওরা ছবি তুলতে গেলে, আমি বলি- এভাবে ছবি না তুলে তোমাদের কোমরে থাকা পিস্তল থেকে আমাকে গুলি কর। তারপর আমার নগ্ন দেহটা টাঙিয়ে দাও। আর তার ভিডিও তুলে ছেড়ে দাও। এতে তোমাদের উদ্দেশ্য আরও সফল হবে। বার বার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে এই কথা বলতে থাকি।
ইতিমধ্যে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এসে ওই বস্তিতে হাজির হয় আমার কয়েক জন সহকর্মী। তারা এই ঘটনার প্রতিবাদ করে। আমাদের দুপুর ২টার সময় আলিপুর আদালত থেকে তোলা হয়েছিল। এই ঘটনার সময় ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটা পার করে গিয়েছিল। মানে আড়াই ঘণ্টা ঘরে লাগাতার আমার উপরে অত্যাচার চলছিল। সহকর্মীদের দেখে আমি আরও গলা চড়াই। তৃণমূলের অন্য যে দলটি চলে গিয়েছিল, তারা ফের ফিরে আসে। আমাকে নগ্ন করে দাঁড় করিয়ে রাখার ঘটনার প্রতিবাদ করতে থাকে। আমার চিৎকার শুনে ততক্ষণে আক্রমণকারীরা কিছুটা হলেও দমে গিয়েছে। বেলা পাঁচটার সময় ওরা পালিয়ে যায়। আমার সহকর্মীরা আমার জামা-কাপড় জোগাড় করে আমাকে দেয়। মোবাইল ফোনও উদ্ধার হয়। কিন্তু, তা থেকে সমস্ত কনট্যাক্ট থেকে শুরু করে সবকিছু ডিলিট করা হয়েগিয়েছল। পেশার তাগিদে বিপদে ঝাঁপানোটা আমাদের কাজ। কিন্তু, কলকাতা শহরের বুকে এমন ঘটনা আজও ঘটে ভেবে সত্যিকারে বিস্মিত বোধ করি। আমি যে জীবন-মৃত্যুর এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিলাম। তা অনুভব করছিলাম। ভরদুপুরে এক সাংবাদিককে অপহরণ করে এমন নৃশংস অত্য়াচার অন্তত আমার জ্ঞানতকালে ঘটেছে কি না মনে পড়ছিল না।'