শহর কলকাতাকে জানতে চান - এই ১৫ টি ঐতিহাসিক ভবনে যেতেই হবে
কলকাতা একটি পুরনো শহর। যদি কেউ সত্যিই শহরটিকে জানতে চায়, তাহলে তাকে এই ১৫টি ভবন পরিদর্শন করতে হবে।
বেশ পুরনো শহর কলকাতা। ১৭৭২ থেকে ১৯১১ - এই দীর্ঘসময় ধরে কলকাতা ছিল বিশাল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। সেই ঔপনিবেশিক সময়ে নির্মিত বহু ভবনই এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ইঁট-কাঠ-পাথরে বহন করছে কত কত অজানা ইতিহাস।
কলকাতায় বসবাসকারী অনেকেই শহরের অত্যাধুনিক মল বা অন্যান্য 'হ্যাপেনিং প্লেস'-গুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেও, এই ঐতিহাসিক ভবনগুলি সম্পর্কে অনেকেরই সম্মক ধারণা নেই। হয়ত অনেকেরই চলাফেরার পথেই এই জায়গা গুলি পড়ে, কিন্তু সেগুলির ইতিহাস সম্পর্কে তাও জানা হয় না অনেক সময়ই। কলকাতাকে জানতে হলে কিন্তু এই অসাধারণ স্থানগুলি একবার করে ঘুরে আসতেই হবে।
ফোর্ট উইলিয়াম
কলকাতায় ব্রিটিশদের নির্মিত প্রথম ভবন ছিল এটি। ইংল্যান্ডেশ্বর তৃতীয় উইলিয়াম নামে এর নামকরণ করা হয়েছিল। ১৬৯৬ থেকে ১৭০৬ - ১০ বছর লেগেছিল এর নির্মাণে। ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাব সিরাজ উদ দৌল্লা হামলা চালান ফোর্ট উইলিয়ামে। এরপর ব্রিটিশরা দুর্গটিকে আজকের দিনের ময়দানে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। পুনর্নির্মাণে ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের খরচ হয়েছিল ২ মিলিয়ন পাউন্ড! এখন এটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর আয়ত্বে রয়েছে। দুর্গের অসামরিক ব্যক্তিদের প্রবেশাধিকার নেই। তবে হুগলির বিভিন্ন ঘাট থেকে এই দুর্গের শোভা উপভোগ করা যায়।
রাইটার্স বিল্ডিং
বেশি পরিচিত রাইটার্স নামেই। ব্রিটিশ শাসনে এটি কেরানিদের অফিস ছিল। স্বাধীনতার পর ২০১৩ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের প্রধান প্রশাসনিক মুখ্যমন্ত্রীর ভবন হিসেবে একে ব্যবহার করা হয়েছে। আপাতত রক্ষণাবেক্ষণের কাজের জন্য ভবনটি বন্ধ রাখা হয়েছে। ১৭৭৭ সালে শহরের এই আইকনিক ভবনটি নির্মিত হয়েছিল। এর মূল কাঠামোটির নকশা করেছিলেন টমাস লায়ন। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন মতো বিভিন্ন সংযোজন করা হয়েছে।
মার্বেল প্যালেস ম্যানসন
উত্তর কলকাতার এই অসাধারণ ভবনটির নির্মাণ হয়েছিল ১৮৩৫ সালে। এই ভবনের সংগ্রহশালায় বহু মূর্তি এবং অন্যান্য সংগ্রহ রয়েছে। বলা যেতে পারে ভারতের অন্যতম সেরা ব্যক্তিগত সংগ্রহের একটি। রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক এই প্রাসাদটির নির্মাণ করেছিলেন। প্রাসাদে গেলে রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক সম্পর্কে অনেক চিত্তাকর্ষক মিথ শুনতে পাওয়া যায়। এর দেওয়াল, মেঝে সবই ইতালীয় মার্বেলে তৈরি। তার থেকেই এর নাম হয়েছে মার্বেল প্যালেস। এই প্রাসাদে রাজেন্দ্র মল্লিক ভারতের সর্বপ্রথম চিড়িয়াখানাও তৈরি করেছিলেন। আজও সেই চিড়িয়াখানায় হরেক রকমের পশুর দেখা মেলে। পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দপ্তরের অনুমতিপত্র থাকলে বিনামূল্যেই এই প্রাসাদে ভ্রমণ করা যায়।
রাজা রামমোহন রায় মেমোরিয়াল
এই ভবনটি কে নির্মণ করেছিলেন তা অজ্ঞাত। ১৮১৫ সালে ফ্রান্সিস মেন্ডেসের কাছ থেকে ত্রিতল এই ভবনটি কিনেছিলেন রাজ রাম মোহন রায়। তখনকার সময়ে খরচ পড়েছিল ১৩০০০ টাকা। উত্তর কলকাতার সিমলায় অবস্থানের জন্য এটি সিমলা হাউস নামেই পরিচিত ছিল। রামমোহন রায়ের অবশ্য এই বাড়িটিতে কখনও থাকার সুযোগ হয়নি। এখানে তিনি সাপ্তাহিক 'আত্মীয় সভা' বসাতেন। লন্ডনে যাওয়ার সময় একমাত্র এই ভবনটি ছাড়া কলকাতার সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছিলেন রামমোহন। তাঁর মৃত্যুর পর, তার ছেলেরা এবং তাঁর পরিবার এই বাড়িতে বাস করা শুরু করেছিলেন। ১৯৬০-এর পর বেস কিছু বেআইনি দখলদারদের হাতে পড়ে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রমে বাড়িটি প্রায় ধ্বংস হতে বসে। ১৯৭২ সালে রামমোহন কলেজ দখল নেয় ভবন ও ভবন সংলগ্ন এলাকার। তারাই বাড়িটিকে রামমোহন রায়ের স্মৃতিসৌধ হিসেবে স্থাপন করে। এখন এখানে একটি সম্বৃদ্ধ সংগ্রহশালা ও লাইব্রেরি রয়েছে।
বেলুর মঠ
এই আধ্যাত্মিক স্থানটি শ্রী রামকৃষ্ণের আদর্শে গঠিত মঠের সদর দপ্তর। রামকৃষ্ণের প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ এই মঠের প্রতিষ্ঠাতা। জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি এই মঠেই কাটান। যেখানে তিনি সমাধি লাভ করেন সেই স্থানটি এখনও বেলুর মঠে গেলে দেখতে পাওয়া যায়। মঠে মা সারদার উদ্দেশ্যে নির্মিত একটি পৃথক মন্দিরও রয়েছে।
গিরিশ চন্দ্র দে এবং নকুর চন্দ্র নন্দী
মিস্টি ছাড়া বাঙালীদের সংস্কৃতি অপূর্ণ থাকে। আর কলকাতায় অন্যতম পুরনো মিষ্টির দোকানগুলির মধ্যে একটি হল এটি। ১৮৪৪ সালে শ্বশুর গিরিশ চন্দ্র দে ও তাঁর জামাতা নকুর চন্দ্র নন্দীর যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় এই দোকান। তারপর থেকে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও তাদের দোকানের মিস্টির খ্যাতি এতটুকু কমেনি। মিষ্টি-প্রেমিকের তীর্থস্থান বলা যেতে পারে এই দোকানকে। বহু বিখ্যাত ব্যক্তি কিন্তু এই দোকানের মিস্টির ভক্ত। সেই তালিকায় আছেন সত্যজিত রায়, উত্তম কুমার এমনকী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও।
সেন্ট থমাস স্কুল, কলকাতা
এটি কলকাতায় প্রাচীনতম এবং দেশের দ্বিতীয় প্রাচীনতম স্কুল! ১৭৮২ সালে খিদিরপুরে এই স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয়। তিনটি ফুটবল মাঠ, দুটি বাস্কেটবল কোর্ট, গির্জার সঙ্গে আরও একটি শিশুদের খেলার মাঠ মিলিয়ে এটি কলকাতার বৃহত্তম স্কুলও বটে। সেইসঙ্গে এখন স্কুল কর্তৃপক্ষ একই স্কুল ক্যাম্পাসেই একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজও চালান।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি
কলকাতা বা বাংলার সঙ্গে সামান্য পরিচয় থাকা কোনও ব্যক্তির জন্যও এই বাড়িটির কোন ভূমিকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ভারতের প্রথম নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই বাড়িতে। শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন ঠাকুর পরিবারের বহু কৃতি ব্যক্তিত্বের স্মৃতি বিজড়িত এই ভবন এখন রবীন্দ্র ভারতী জাদুঘর। সারা বছরই এখানে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। তবে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী এবং অবন মেলার সময়ে এই বাড়িতে অনুরাগীদের বাড়তি ভিড় দেখা যায়।
১/১ বিশপ লেফ্রয় রোড
ঠাকুরদের পরেই বাংলার সংস্কৃতি সবচেয়ে বেশি অবদান রায় পরিবারের। আর এই বাড়িটি হল রায় পরিবারের সবচেয়ে খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব সত্যজিত রায়ের বাসভবন। যে কোনও চলচ্চিত্র নির্মাতা বা জন্য চলচ্চিত্র-প্রেমীদের জন্য এটি একটি তীর্থস্থানের চেয়ে কম নয়। শুধু চলচ্চিত্রই বা কেন বাংলা সাহিত্যের ফেলুদা বা প্রফেসর শঙ্কুর জন্মও হয়েছিল এই বাড়িটিতেই। ১৯৭০ সালে বাড়িটি কিনেছিলেন সত্যজিত। তার আগে ভবনটি পরিচিত ছিল কলকাতা ম্যানশন নামে। বিশপ লেফ্রয় রোডের প্রথম ভবনটিই এটি। এছাড়া এই একই রাস্তায় ভবানীপুর সিমেটারি, নেতাজি ভবনের মতো আরও বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ভবন রয়েছে। বর্তমানে রাস্তাটির নাম হয়েছে সত্যজিত রায় ধরণী।
ইডেন গার্ডেন
ভারতে সবচেয়ে বড় ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়াম ইডেন গার্ডেন। শুধু আয়তনের বিশালত্ব নয়. ইডেন গার্ডেন পরিচিত এখানকার দর্শকদের বিশাল হৃদয়ের জন্যও। স্টেডিয়ামটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৬৪ সালে! বাইবেল-এ উল্লিখিত 'গার্ডেন অব ইডেন'-এর নামে এর নামকরণ করা হয়েছিল।
সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল
এঙ্গলিকান কমিউনের অংশ টার্ট অব নর্থ ইন্ডিয়ার অন্যতম এঙ্গলিকান ক্যাথেড্রাল হল সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল। এর ভবনটিই পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র। এর আশপাশের এলাকাতেই আছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, নন্দন, রবীন্দ্র সদন থিয়েটার কমপ্লেক্স, বিড়লা প্ল্যানেটারিয়ামের মতো কলকাতার অনেক আকর্ষণ।
মেটিয়াবুরুজ
এলাকাটি বর্তমানে গার্ডেনরিচ নামে পরিচিত। আওধ থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহ। তিনিই এলাকাটির নামকরণ করেছিলেন মেটিয়াবুরুজ। কলকাতার এই অংশকে ওয়াজিদ আলি লখনৌয়ের মতো করেই গড়তে চেয়েছিলেন। মেটিবুরুজে তিনি দ্বিতীয় ইমামবারাও নির্মাণ করান। এখানে ওয়াজিদ আলির সমাধিও রয়েছে। মেটিবিরুজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ ঘুড়ি প্রস্তুতকারক এলাকা হিসেবে পরিচিত। ভারতের সবচেয়ে বড় সাপ্তাহিক হাটও বসে একানে।
জাতীয় গ্রন্থাগার
এটি ভারতের সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার। বিভিন্ন বিষয়ের চর্চা করতে পন্ডিতরা আসেন এই গ্রন্থাগারে। তবে এর বিপুল গ্রন্থের সংগ্রহের পাশাপাশি আরেকটি আকর্ষণও রয়েছে। এই ২৫০ বছরের পুরনো বাড়িটিতে বিভিন্ন সময়ে অনেকেই দাবি করেছেন, ভুত আছে। ভুত থাকুক না থাকুক কলকাতা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বেলভেডের এভিনিউতে অবস্থিত জাতীয় গ্রন্থাগারটিতে একটা বেশ গা ছমছমে ব্যাপার রয়েছে।
স্টার থিয়েটার
১৮৮৩ সালে এটি নির্মিত হয়েছিল। কলকাতার প্রথম বাণিজ্যিক সিনেমা হলগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। প্রথমদিকের বাংলা চলচ্চিত্রগুলি প্রদর্শিত হয়েছিল এখানে। একবার অগ্নিকাণ্ডে অধিকাংশ ভবনটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেলেও এর বেশির ভাগই কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশন পুননির্মাণ করতে পেরেছে। ভবনটির বাইরের চেহারাটা যতই আদ্যিকালের হোক অভ্যন্তরের সবকিছু কিন্তু আধুনিক সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে গড়া হয়েছে। সপ্তাহের দুই দিন করে এখানে এখনও নাটক অভিনিত হয়।
ক্লাইভ হাউস
অনেকেরই মতে এটিই কলকাতার প্রাচীনতম ভবন যা এখনও মাথা তুলে রয়েছে। পলাশীর যুদ্ধে জয়ের পর লর্ড ক্লাইভ এই বাড়িটি কিনেছিলেন। বেশিরবাগ অংশই প্রায় ধ্বংস হয়ে গেলেও এর কিছু অংশ এখনও অক্ষত রয়েছে। মনে করা হয়, একসময়ে এই ভবনটি সেনা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হত, যাকে হিন্দিতে যাকে বলা হত দমদামা। তার থেকেই এলাকাটির নাম দমদম হয়েছে বলে মনে করা হয়।