প্রসব: সন্তান জন্মদানের সময় এপিসিওটমি কেন করা হয়, কী ঘটে?
চিকিৎসকেরা অনেক সময় স্বাভাবিক প্রসব চলাকালে যোনিপথ ও পায়ুপথের মাঝখানে একটু কেটে প্রসবের পথ প্রসারিত করে দেন। এই পদ্ধতির নাম এপিসিওটমি।
সাধারণত 'সার্জিকাল' কাঁচি দিয়ে এক থেকে দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত কাটা হয়ে থাকে। কাটার আগে জায়গাটি অবশ করার জন্য ইনজেকশন দেয়া হয়।
বাংলাদেশে স্বাভাবিক প্রসবকালে এটি বেশ নিয়মিত করা হয়। যদিও অত্যন্ত জরুরি না হলে এপিসিওটমি না করার ব্যাপারে বেশ কিছুদিন ধরে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
যে কারণে এটি করা হয়
যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা সংস্থা এনএইচএসের তথ্য মতে, সাধারণত বাচ্চার আকার যদি বড় হয়, যার ফলে বাচ্চা বের হতে সমস্যা হয়, এবং প্রসবের সময় যোনিপথ ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখন অনেক সময় এটি করা হয়।
বাচ্চার যদি কোন সমস্যা তৈরি হয় যার ফলে দ্রুত প্রসবের প্রয়োজন, বাচ্চার মাথার বদলে নিচের অংশ আগে বের হচ্ছে, কয়েক ঘন্টা ধরে চেষ্টার পর মা ক্লান্ত হয়ে গেছেন, এসব কারণে এপিসিওটমি করার প্রয়োজন হতে পারে।
এনএইচএস বলছে, প্রথমবার মা হচ্ছেন এমন নারীদের দশজনের মধ্যে নয়জনের প্রসবের সময় যোনিপথ ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
তাই তাদের ক্ষেত্রে এপিসিওটমি বেশি করা হয়। পরিস্থিতি বুঝে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেন।
এপিসিওটমির অভিজ্ঞতা
সারাহ্ ইসলাম ২৮ বছর বয়সে প্রথম মা হয়েছেন। তিনি বলছিলেন বাংলাদেশে অনেক বেশি সিজারিয়ান করা হয় বলে শুনেছেন। তাই শুরু থেকেই স্বাভাবিক প্রসব করবেন সেরকম ইচ্ছে ছিল তার।
চিকিৎসক তাকে আগে থেকেই এপিসিওটমি করা হবে বলে ধারণা দিয়ে রেখেছিল।
সারাহ্ ইসলাম তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলছিলেন, "আমার ডাক্তার আমাকে বলে নিয়েছিলেন যে বাচ্চা হওয়ার সময় একটু কেটে দিলে সুবিধা হবে। বাচ্চা হওয়ার একদিন পর হাসপাতাল থেকে বাসায় গিয়ে ভাল করে একটু পরিষ্কার হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্যাম্পু করে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করেছিলাম। এরপর দেখি কাটা জায়গাটার ওখানে ব্যথা শুরু হয়েছে। অনেক ব্যথা হচ্ছিল। ব্যথায় বসতে পারছিলাম না।"
টয়লেট ও চেয়ারে বসতে প্রথম কয়েকদিন বেশ সমস্যা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সারাহ্ ইসলাম। কাটা স্থান নিয়ে বেশ ভয়ও পেয়েছিলেন।
"আমার টয়লেটে বসতে খুব ভয় করতো। যদি সেলাই ছিঁড়ে যায়, এই ভয়টা পেয়েছিলাম। তবে ডাক্তার নার্স সবাই আমাকে বলেছে যে টয়লেটে বসলে সেলাই ছিঁড়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। আমার মা একটা ইঁট এনে সেটাকে চুলায় গরম করে মোটা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে আমাকে দিয়েছিল। আমি সেটার ওপরে বসে থাকতাম ব্যথা কমানোর জন্য।"
গ্রামাঞ্চলে এটি এখনো করা হয়। অনেক সময় মাটির হাঁড়ি গরম করে কাপড় দিয়ে সেঁক দেয়া হয়।
সারাহ্ ইসলাম একসময় টের পেলেন তার কাটা জায়গার সেলাই-এ সামান্য ইনফেকশন হয়েছে।
নারীত্ব, যৌনতা, আবেগ, রজঃনিবৃত্তির প্রভাব নিয়ে যত প্রশ্ন
যমজ শিশু জন্মের কারণ ও ঝুঁকি সম্পর্কে আপনার যা জানা প্রয়োজন
চিকিৎসার সময় ডাক্তারের কাছে রোগীর যেসব অধিকার থাকে
এপিসিওটমি থেকে সেরে উঠতে সাত দিনের মতো সময় লাগে।
কিন্তু ইনফেকশনের কারণে সারাহ্ ইসলামের ক্ষেত্রে এক মাসের মতো লেগেছিল।
যেসব সমস্যা হতে পারে
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. কিশোয়ার সুলতানা বলছেন সঠিকভাবে করা হলে কয়েকদিন ব্যথা ছাড়া অন্য কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
এপিওসিওটমি স্বাভাবিকভাবে এমনিতেই সেরে যায়। কোন মলম ও অ্যান্টিবায়োটিক দেবার প্রয়োজন হয় না।
তবুও যেসব সমস্যা তৈরি হতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন ডা. কিশোয়ার সুলতানা।
"এর একটি হল কাটা জায়গা পরিষ্কার না রাখলে ইনফেকশন বা প্রদাহ হতে পারে। এর ফলে কাটা জায়গা শুকাতে ও জোড়া লাগতে দেরি হয়। আমরা সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দেই।"
এনএইচএসের তথ্য মতে, সন্তান জন্মদানের সময় এপিসিওটমির ফলে বাড়তি রক্তক্ষরণ হয় যা সমস্যা তৈরি করতে পারে।
পায়ুপথের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মল ত্যাগে সমস্যা হতে পারে, প্রস্রাব ধরে রাখায় সমস্যা হতে পারে।
এপিওসিওটমির পর কয়েক মাস যৌন সঙ্গমের সময় ব্যথা হতে পারে। এপিসিওটমি করা হলে কিছু ক্ষেত্রে যৌন সঙ্গমের সময় ব্যথা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে।
এপিসিওটমির সময় নার্ভ কাটা পড়ে যা দীর্ঘ মেয়াদি ব্যথার কারণ হতে পারে।
এপিসিওটমির কারণে দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যথা থাকতে পারে।
হাঁটা, বসা ও প্রসবের সময় ব্যথা হতে পারে। সবার ক্ষেত্রে সকল সমস্যা হবে এমন নয়।
কারো হয়ত এক বা একের অধিক সমস্যা হতে পারে। আবার কারো ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নাও হতে পারে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন
যদি বেশিদিন ব্যথা থাকে, কাটা জায়গা থেকে পুঁজ অথবা গন্ধযুক্ত কিছু বের হয়, কাটা জায়গার আশপাশ লাল হয়ে যায়, ফুলে যায়, জ্বর হয় - এর একটি যদি চোখে পড়ে তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।
যা করতে পারেন
বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আরমানা ইসলাম কিছু পরামর্শ দিচ্ছেন।
"যেহেতু মাত্র মা হয়েছেন, ৪০ দিনের মতো ব্লিডিং হবে। শুরুতে বেশি হবে। তাই যতবার টয়লেটে যাবেন জায়গাটা পরিষ্কার রাখতে হবে, শুকনো রাখতে হবে, সময়মত প্যাড বদলাতে হবে। সাবান, ডেটল বা স্যাভলন ব্যাবহার করা যাবে না।"
মল যাতে নরম থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। মাটিতে ও পিঁড়িতে বসা যাবে না।
মাস খানেক ভারী কিছু বহন, শরীরের উপরে চাপ পড়ে এমন কাজ থেকে বিরত থাকুন।
সহবাসে ব্যথা হলে সঙ্গীকে জানাতে হবে। কখন সহবাস করা যাবে সেটি চিকিৎসকের কাছে যেনে নিন। এক্ষেত্রে তার সহায়তা অনেক জরুরি।
ডা. আরমানা ইসলাম বলছেন, "খুব কম নারী এই সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। এপিসিওটমির কারণে সহবাসে সমস্যা হলে আমরা লুব্রিকেন্ট ব্যাবহার করতে বলি।"
ব্যথা কমাতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথানাশক ঔষধ সেবন করতে পারেন।
এক্ষেত্রে প্যারাসিটামল সবচেয়ে নিরাপদ। চিকিৎসকের এপিওসিওটি'র পর 'হিপ বাথ' করতে বলেন।
অর্থাৎ বড় গামলায় গরম পানি ঢেলে তাতে বসে থাকলে ব্যথার উপকার পাওয়া যায়।
ব্যথা কম লাগার জন্য বালিশের উপরে বসা যেতে পারে।
কাটা স্থান কিছুক্ষণ খোলা রাখলে ক্ষত দ্রুত শুকাতে সহায়তা করবে।
"যোনি ও পায়ুপথের পেশি খিঁচে ধরা - আমরা অনেক সময় প্রস্রাব পায়খানা আটকাতে যেটা করি। দিনের যেকোনো সময় দশ পনেরবার এটি করলে উপকার পাওয়া যায়।"
এপিওসিওটমি এড়াতে হলে কিছু বিষয় সহায়ক হতে পারে। যেমন পেরিনিয়াল মাসাজ ও ব্যায়াম। গর্ভাবস্থায় যোনি ও আশপাশ মালিস করা।