কার্টুন, বাউল গান এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভয়ের সংস্কৃতির অভিযোগ কেন উঠছে
বাংলাদেশে কার্টুনিস্ট, বাউল শিল্পী, নাট্যকারসহ সাংস্কৃতিক কর্মী বা শিল্পীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যহত হওয়ার মতো ঘটনা বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
সাংস্কৃতিক কর্মীদের অনেকে এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে বর্ণনা করেছেন।
তারা বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কার্টুনিস্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমের অনেক শিল্পীকে আটক বা হয়রানির ঘটনায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও বিবৃতি দিয়ে আটক কার্টুনিস্ট ও শিল্পীদের মুক্তি চেয়েছে।
তবে সরকার এসব অভিযোগ মানতে রাজি নয়।
আরও পড়ুন:
- কার্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মুশতাকের মুক্তি চায় অ্যামনেস্টি
- ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ায় অভিযুক্ত বাউল রিতা দেওয়ান কী বলছেন?
- বয়াতি-বাউলরা কি এখন নির্ভয়ে গান করতে পারবেন?
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর এবং লেখক মুশতাক আহমেদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাগারে রয়েছেন প্রায় আট মাস ধরে।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তারা ফেসবুকে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি এবং জাতীয় পতাকার অবমাননা করার অভিযোগও আনা হয়েছে।
কার্টুনিস্টদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, নানা ধরনের অভিযোগ দিয়ে আটক বা হয়রানির ঘটনা ঘটছে।
তারা বলেছেন, পত্রপত্রিকায় একস ময় রাজনৈতিক কার্টুন ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে পত্র-পত্রিকাও ঝুঁকি নিতে চায় না। ফলে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকা একেবার কমে গেছে।
অন্যতম একজন কার্টুনিস্ট রাশেদ ইমাম তন্ময় নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, "একটি দৈনিক ইংরেজি পত্রিকায় এডিটরিয়াল কার্টুনিস্ট হিসাবে চাকরি করতাম। সেখানে দেখা গেছে, আস্তে আস্তে কার্টুন ছাপানোর পরিসর কমে এসেছে। আগে আমি চারটি কার্টুন করলে একটা কার্টুন ছাপা হতো।
"গত চার পাঁচ বছরে দেখালাম যে সংখ্যাটা কমে আসলো এবং শেষের দিকে আমার কোন কার্টুনই ছাপা হতো না। তখন আমি চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। এরকম আমি আরও কিছু কার্টুনিস্টের ঘটনা জানি।"
এই কুর্টনিস্ট আরও বলেন, "যখন পত্রিকায় হচ্ছে না, তখন আমি মনে করলাম যে, ডিফারেন্ট মিডিয়া অর্থ্যাৎ সামাজিক মাধ্যমে আমি কার্টুন আঁকবো। সামাজিক মাধ্যমে যখন কার্টুন করি। ওভার দ্য ইয়ার্স দেখলাম, একটা কিছু করলেই যারা কার্টুন ভালবাসে, তারা এসে লিখতো যে ভাই সাবধান। ব্যাপারটা হচ্ছে এরকম যে কী দরকার ঝামেলায় গিয়ে?"
বাউল শিল্পী শরিয়ত সরকার ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গত বছর জেল খেটেছেন। তিনি বলছেন, এখন গান গাইতে তার ভয় কাজ করে।
গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে টাঙ্গাইলে পালাগানে অংশ নিয়েছিলেন বাউল শিল্পী রিতা দেওয়ান।
এরপর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়। তিনি এখন জামিনে মুক্ত রয়েছেন।
তার স্বামী মো: আশরাফুল ইসলামও একজন বাউল শিল্পী। তিনি জানান, মামলার পর এক বছর ধরে তাদের গানবাজনা বন্ধ হয়ে রয়েছে।
সম্প্রতি একটি নতুন সিনেমার ট্রেইলার প্রকাশ হওয়ার পর সেই সিনেমার পরিচালক এবং অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে পর্নোগ্রাফি নিরোধ আইনে।
সিনেমাটির ট্রেইলারে একজন পুলিশ কর্মকর্তার জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষণের শিকার একজন নারীর হেনস্তা হওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়।
মঞ্চ নাটকসহ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতাদের অনেকে মনে করেন, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সব মাধ্যমেই মত প্রকাশের অধিকার ব্যাহত করার ঘটনা বাড়ছে।
নাট্যকার এবং অভিনেতা মামুনুর রশিদ বলেন, "খুবই উদ্বেগজনক বলে আমি মনে করি। কারণ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কার্টুনিস্ট, বাউল শিল্পী, এর আগে ফরিদপুরে একজন নাট্যকারকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। শেষ পর্যন্ত তাকে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বাঁচানো হয়।"
"এই প্রবণতা যদি চলতে থাকে, তাহলে তো আমরা ভয় পেয়ে যাবো। ভায় পেলেতো কোন সৃজনশীল কাজ হবে না এবং সত্য প্রকাশ হবে না।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা মঞ্চ নাটকের আন্দোলনের সাথে রয়েছেন। তিনি বলেন, একদিকে ভয়, অন্যদিকে সেল্ফ সেন্সরশিপ রয়েছে সাস্কৃতিক অঙ্গনে।
"আমরা কী নিয়ে কথা বলবো, আমরা সরকারের বিরুদ্ধে কতটুকু যেতে পারবো - সেটার একটিা সেল্ফ সেন্সশিপ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবশ্যই রয়েছে। আর বেশিরভাগ সংস্কৃতিকর্মীই সরকারকে সংস্কৃতি-বান্ধব মনে করে। সেই অবস্থায় সেভাবেই তারা কাজটাকে সাজায়। সে কারণেও সেল্ফ সেন্সরশিপ কাজ করে।"
মিজ লুৎফা আরও বলেন, "আর রিতা দেওয়ান বা শরিয়ত বয়াতি-এদের ক্ষেত্রে যেটা ঘটে, সূফি দর্শনের সাথে যে এক ধরনের দ্বন্দ্বের জায়গা তৈরি হয়ে যায়, সেখান থেকে ঘটে। আর কিশোর এবং মুশতাকের ক্ষেত্রে এটা বলা যায়, যেহেতু তারা সরকার-বিরোধী কথা লিখেছেন, সেজন্য তাদের ধরা হয়েছে। এটা আসলে একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার অংশ।"
তবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মত প্রকাশের অধিকার ব্যাহত করার এসব অভিযোগ মানতে রাজি নন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে. এম. খালেদ।
তিনি বলেন, "আমরা সংস্কৃতিকে সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখি। এখন কারও বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়ে থাকলে আইনী বিধান যা আছে, তা হবে। অযথা যদি কেউ হয়রানি শিকার হয়, সেটা নিশ্চয়ই আমরা দেখবো।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, "সরকারের সমালোচনা না করলে তো সরকারই সঠিকভাবে চলবে না। আমরাতো গঠনমূলক সমালোচনাকে আমন্ত্রণ জানাই।"
এদিকে সাংস্কৃতিক কর্মীরা বলছেন, অভিযোগ নাকচ না করে সরকারের উচিত বিষয়টাতে নজর দেয়া।
বিবিসি বাংলায় অন্যান্য খবর:
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার নীতিগত সিদ্ধান্ত, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে কিভাবে
- বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকা নেয়ার আগে-পরে করনীয়
- পরিচিত যেসব পতঙ্গ আর প্রাণী বিষ ছড়ায়, এমন কি মৃত্যুও ঘটায়