যেদিন প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রকাশ্যে কেঁদেছিলেন
রুশরা তাদের প্রেসিডেন্টকে খুব বেশি কাঁদতে দেখেনি। ভ্লাদিমির পুতিন কাঁদছেন এমন ঘটনা দেখা গেছে একবারই - তার রাজনৈতিক গুরু ও বন্ধুর মৃত্যুর পর । কি ঘটেছিল সেদিন?
রুশরা তাদের প্রেসিডেন্টকে খুব বেশি কাঁদতে দেখেনি, যদিও তার ১৮ বছরের শাসনকালে রাশিয়া শোকাবহ ঘটনার কোন অভাব ছিল না।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কাঁদছেন এমন ঘটনা দেখা গেছে একবারই - ২০০০ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি। ঘটনাটা ঘটেছিল তার রাজনৈতিক গুরু আনাতোলি সোবচাক মারা যাবার পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন।
কে এই সোবচাক?
বিবিসির গ্যাব্রিয়েল গেটহা্উস লিখছেন, গরবাচেভ এবং ইয়েলৎসিনের মত যে কয়েকজন সংস্কারপন্থী লোক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পেছনের মুখ্য ব্যক্তি ছিলেন - তাদের একজন ছিলেন এই সোবচাক।
ভ্লাদিমির পুতিন নামে কেজিবির একজন মাঝারি স্তরের কর্মকর্তা - যাকে প্রায় কেউই চিনতেন না - তাকে তুলে এনে প্রথম রাজনৈতিক দায়িত্বও দিয়েছিলেন এই সোবচাক।
কেন তিনি এই ভ্লাদিমির পুতিনকে তুলে এনেছিলেন তা কেউ জানে না।
বিবিসি বাংলায় আরো পড়ুন:
রাশিয়ার নতুন ক্ষেপণাস্ত্র: বাস্তব না কল্পনা ?
অনলাইনে উস্কানিমূলক মন্তব্য: কী আইন আছে?
'গালি দেয়, গায়ে হাত দেয়, প্রতিবাদ করলে চাকরি নাই'
কিন্তু সেই কেজিবির বিভিন্ন উপদল এখন রাশিয়ার ক্ষমতার কলকাঠির ওপর নিয়ন্ত্রণ এমনভাবে পাকা করে ফেলেছে যে দেশটিতে এখন গণতন্ত্র এখন একটা নামসর্বস্ব ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
আগামী ১৮ই মার্চ রাশিয়ায় নির্বাচন। এতে ভ্লাদিমির পুতিনই প্রধান প্রার্থী, এবং নির্বাচনের ফল কি হবে তা নিয়েও কারো কোন সন্দেহ নেই। তবে হ্যাঁ - এই নির্বাচনে একজন 'বিরোধীদলীয়' প্রার্থী আছেন তার নামটা মনে রাখুন। ৩৬ বছর বয়স্ক সেনিয়া সোবচাক - মি. পুতিনের পুরোনো বন্ধু এবং রাজনৈতিক গুরু আনাতোলি সোবচাকের মেয়ে।
রাশিয়ার 'আসল' বিরোধীদলীয় নেতা নাকি আলেক্সেই নাভালনি। কিন্তু তাকে নির্বাচন করতে দেয়া হচ্ছে না। নাভালনির লোকেরা বলেন, এই সেনিয়া আসলে ক্রেমলিনের পুতুল - তাকে মি. পুতিনই নির্বাচনে নামিয়েছেন, যাতে এই ভোটকে একটা বিশ্বাসযোগ্যতা দেয়া যায়।
তবে ক্রেমলিনের লোকেরাই যদি সেনিয়াকে নির্বাচনে নামিয়ে থাকেন , তাহলে হয়তো এখন তারা তাদের হাত কামড়াচ্ছেন। কারণ সেনিয়া সোবচাক তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় এমন সব কথা বলছেন তাকে অনেকেরই চোখ কপালে উঠেছে।
সেনিয়া সোবচাক টিভির পর্দায় মি. পুতিনের দুর্নীতিবাজ তাঁবেদারদের নাম প্রকাশ করে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, রাশিয়া যে ক্রাইমিয়া দখল করে নিয়েছে তা বেআইনি। তিনি আরো বলছেন, "আমি নির্বাচনে জিতবো না, সবাই জানে কে জিতবে। কিন্তু তাহলে কেন আমি নির্বাচন করছি? আমি চাই আমার কথা লোকে শুনুক।"
বলতেই পারেন, রাশিয়ার নির্বা্চনে তাহলে হচ্ছেটা কি?
১৯৯০এর দশকে সেনিয়ার পিতা আনাতোলি সোবচাক ছিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গের মেয়র। পুতিন ছিলেন তার ডেপুটি। তারা এতই ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে সোবচাকের বিরুদ্ধে একবার যখন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল - তখন পুতিন তাকে বিশেষ বিমান চার্টার করিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
রাশিয়ায় তথন চলছে চরম বিশৃঙ্খলা। প্রেসিডেন্ট বোরিস ইয়েলৎসিক প্রায় সময়ই মদে চুর হয়ে থাকেন, কোন কাজই প্রায় তিনি করতে পারেন না। ক্রেমলিনের ধূসর স্যুটপরা লোকেরা তখন ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে এলেন ঠিক তার উল্টো একজন লোককে - যার নাম ভ্লাদিমির পুতিন, ইয়েলৎসিনের উত্তরাধিকারী হিসেবে তাকে তৈরি করা হতে লাগলো।
এই সময়ই - যখন মি. পুতিন প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট হবার পথে - তখনই হঠাৎ করে আনাতোলি সোবচাক মারা গেলেন, কালিনিনগ্রাদে এক হোটেল কক্ষে। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ বলা হলো কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট - কিন্তু হার্ট এ্যাটাকের কোন লক্ষণ পাওয়া গেল না।
সোবচাকের স্ত্রী লু্দমিলা নারুসোভার সন্দেহ এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। তাকে কি খুন করা হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি একবার বলেন, 'হ্যাঁ' আবার বলেন 'আমি জানি না।'
তার মৃত্যুর পেছনে ভ্লাদিমির পুতিনের হাত আছে - এমন আভাস দিয়েছেন অনেকে। কিন্তু নারুসোভা এ কথা সরাসরি নাকচ করে দিলেন।
সোবচাকের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের ভিডিওতে দেখা যায়, পুতিন একেবারেই শোকাহত, তার চোখ লাল। তিনি অভিনেতা নন, তিনি প্রকাশ্যে তার আবেগ দেখান না। তাই ধরে নেয়া চলে তার এই শোকে কোন ভেজাল নেই। নাকি এটা অন্য কিছু - কোন অপরাধবোধ?
নারুসোভা বলেছেন, একদল লোক পুতিনকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য কাজ করছিল।
তখন ক্রেমলিনের ভেতরে বিভিন্ন উপদলের ক্ষমতার চাবিকাঠি ছিলেন পুতিন। কিন্তু পুতিনের ওপর প্রভাব ছিল সোবচাকের । একারণেই কি কোন একটি উপদল সোবচাককে সরিয়ে দিয়েছিল? পুতিন কি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে আনার জন্যই তার বন্ধুকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে?
বলতেই হবে, এটা শুধুই একটা সন্দেহ মাত্র - লিখছেন গ্যাব্রিয়েল গেটহাউস।
সোবচাকের স্ত্রী নারুসোভা নিজেই তার স্বামীর মৃতদেহের একটা ময়নাতদন্ত করিয়েছিলেন। তার রিপোর্ট তিনি আজও প্রকাশ করেন নি। সেটা রক্ষিত আছে রাশিয়ার বাইরে একটা গোপন সিন্দুকে। এটা নিয়ে তিনি কথাও বলতে চান না।
তিনি কি তার মেয়ের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্ন?
নারুসোভা বললেন, 'এ দেশে বাস করাটা একটা ভয়ের ব্যাপার। বিশেষ করে যারা সরকারবিরোধী তাদের জন্য তো বটেই। তাই... হ্যাঁ, আমি ভীত।"