যেবার নৌযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার
২০০৮ সালের নভেম্বর মাস। বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস খুঁজতে নেমেছে মিয়ানমার। অনুসন্ধান দলকে পাহারা দিচ্ছে দুটো যুদ্ধজাহাজ। চ্যালেঞ্জ করতে সেখানে ছুটে গেছে বাংলাদেশের চারটি যুদ্ধজাহাজ। টানা নয় দিনের এক শ্বাসরুদ্ধকর এক যুদ্ধাবস্থ
“বাংলাদেশ ও বার্মা, বিশ্বের দরিদ্রতম দুটি দেশ বিতর্কিত গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে বাড়তে থাকা উত্তেজনার মধ্যে বঙ্গোপসাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে” - ২০০৮ সালের ৪ঠা নভেম্বর প্রকাশিত ব্রিটিশ গণমাধ্যম দা গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদনের শুরুটা ছিল এমন।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মাধ্যমেও উঠে আসে সমুদ্রে বাংলাদেশ-বার্মার নৌবাহিনীর মুখোমুখি অবস্থানের বিষয়টি। (ওই ঘটনা নিয়ে বিবিসি নিউজে প্রকাশিত খবর)
তখন সমুদ্রে মিয়ানমার বা ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারিত ছিল না।
আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দেশদুটিকে দরিদ্র হিসেবেই দেখা হতো। ফলে সম্পদের প্রশ্নে টানাপোড়েনও ছিল বেশি।
গ্যাস আহরণে দ্বন্দ্ব
বঙ্গোপসাগরে প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষত গ্যাস ও তেলের আধার থাকতে পারে এমন ধারণা দিচ্ছিলেন বিশেষজ্ঞরা।
মিয়ানমার গ্যাসের যে হিসাব নিকাশ করছিলো সেদিকে ভারত এবং কোরিয়ারও আগ্রহ ছিলো।তবে বাংলাদেশকে এখানে অনেকটা বাধা হিসেবেই দেখা হচ্ছিলো বলে উঠে আসে বিভিন্ন নিবন্ধে।
তেল বা গ্যাস যে কোন দেশের অর্থনীতির জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সেসময় বাংলাদেশে সমুদ্রে গ্যাসক্ষেত্র ইজারা দেয়ার প্রস্তাব অনুমোদন প্রক্রিয়া চলছিল যেটা নিয়ে বিতর্ক চলছিলো।
তখনো দেশে জরুরি অবস্থা চলছে এবং অনির্বাচিত সরকারের গ্যাসক্ষেত্র বিদেশি কোম্পানিকে তুলে দেয়ার বিরুদ্ধে ৩১শে অক্টোবর (২০০৮) একটি মানববন্ধনও হয়।
তবে বাংলাদেশের সেসব গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে মিয়ানমারের সাথে বিরোধ ছিল না।
কিন্তু মিয়ানমার যেদিকে গ্যাস অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করছিলো সে জায়গাটি কোন দেশের অংশ সেটা পুরোপুরি পরিষ্কার ছিল না।
মিয়ানমার দাইয়ু নামে একটি কোরিয়ান কোম্পানির সাথে চুক্তি করে সাগরে তেল গ্যাস আহরণের দায়িত্ব দেয়।
তারাই সমুদ্রে গ্যাসের অনুসন্ধানে ড্রিলিং চালাতে ৪টি জাহাজ নিয়ে নামে। তাদের পাহারায় ছিলো মিয়ানমার নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধজাহাজ।
মুখোমুখি অবস্থান
দিনটি ছিল ২০০৮ সালের নভেম্বরের ১ তারিখ শনিবার।
মিয়ানমারের জাহাজের উপস্থিতি টের পেয়ে তাদের চ্যালেঞ্জ করতে অবস্থান নেয় বাংলাদেশের মোট ৪ টি জাহাজ।
বিএনএস নির্ভয়, বিএনএস আবু বকর ও বিএনএস মধুমতি এই ৩ টি জাহাজ প্রথমে অবস্থান নেয়, এরপর বিএনএস কপোতাক্ষ নামেও আরেকটি ফ্রিগেট জাহাজ তাদের সাথে যোগ দেয়।
মূলত নভেম্বরের ৩ তারিখ বিষয়টি সংবাদমাধ্যমগুলোতে উঠে আসে।
সেদিন দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় উল্লেখ করা হয় যে ১ তারিখ সকালে নৌ বাহিনীর টহল জাহাজ বাংলাদেশের সীমানায় ৪ টি জাহাজ দেখতে পায়।
নৌবাহিনী তাদের সরে যেতে বলার পর বেলা ১২ টার দিকে ৩ টি জাহাজ চলে যায়, কিন্তু বিকেল সাড়ে ৪ টায় আবার ফিরে আসে।
একই প্রতিবেদনে এও বলা হয় সেসব জাহাজের দুটি বাহামার, একটি ভারতের ও একটি বেলিজের এবং সেখানে অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও মিয়ানমারের ২০০ প্রকৌশলী-কর্মী রয়েছেন।
বাংলাদেশি সূত্র দিয়ে বিবিসি নিউজের ইংরেজি খবরে উল্লেখ করা হয় যে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের প্রায় ৫০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে ঘটনাটি ঘটেছে যেটাকে বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ হিসেবে দেখছে।
বিরোধপূর্ণ সে এলাকা নিজেদের বলে দাবি ছিল বাংলাদেশ মিয়ানমার দুই দেশেরই।
সমাধান হয়েছিলো যেভাবে
ঘটনাটি ঘটার পর পরই নৌবাহিনী বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায় এবং কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়।
ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে দুই দফায় তলব করে প্রতিবাদ জানানো হয়।
বিষয়টি তখন কূটনীতিকদের কিছুটা অবাক করেছিলো কারণ এর আগের মাসেই মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা ৫৫ সদস্যের প্রতিনিধিদল নিয়ে বাংলাদেশ সফর করেছিলো।
দুই দেশের সম্পর্কও খুব বেশি খারাপ ছিল না।
চৌঠা নভেম্বর মঙ্গলবার রাতে মিয়ানমারে ঝটিকা সফরে যান তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন। যদিও সে সফর খুব একটা ফলপ্রসূ কিছু ছিলো না।
বরং ৪ তারিখেই ইয়াঙ্গনে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতকে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে বাংলাদেশের নৌযানকে ঐ এলাকা ছাড়তে বলে ( ৫ই নভেম্বর, দৈনিক যুগান্তর)।
কিন্তু সমস্যার প্রাথমিক সমাধানটা হয়েছিলো একটু অন্যভাবে।
তৎকালীন বাংলাদেশে কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনের পুরনো বন্ধু।
মি. হোসেন বিবিসি বাংলাকে জানান, তিনি কোরিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বিষয়টি অবহিত করে বলেন “আমি আশা করি ওখানে কোনো গোলাগুলি হবে না। যেহেতু দুই পক্ষেই জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে, যদি গোলাগুলি হয় তোমার লোকজন কিন্তু মারা যাবে। আমি অনুরোধ করবো তোমরা জাহাজটাকে সরে যেতে বলো। কারণ মিয়ানমার কিছু করবে না আমি বুঝতে পারছি”।
তখন কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক সুখবুম তাঁকে আশ্বাস দেন যে শীঘ্রই তিনি একটা ব্যবস্থা করবেন। যেহেতু ড্রিলিং-এর দায়িত্বে ছিল কোরিয়ান কোম্পানি তাই তাদের নিরাপত্তার দিকটিও ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
ছয়ই নভেম্বর মানবজমিন রিপোর্ট করে যে, কোরিয়ান কোম্পানি দাইয়ু অমীমাংসিত সমুদ্র এলাকায় তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান বাতিল করেছে এবং গভীর সমুদ্র থেকে তাদের জাহাজ প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
যদিও জাহাজগুলি সরে যায় নভেম্বরের ৯ তারিখ।
অর্থাৎ প্রায় ৯ দিন এমন মুখোমুখি অবস্থানে ছিল জাহাজগুলি। তবে থমথমে অবস্থা চলতে থাকে স্থল সীমান্তের দিকে।
এরপর দফায় দফায় এসব বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে বৈঠক চলতে থাকে।
যদিও সীমানা নির্ধারনের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছিলো না।
শেষ পর্যন্ত সেই সমাধান আসে ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে।
এছাড়া এই ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে আরো শক্তিশালী করার পদক্ষেপও নেয়া হয়।