মার্টিন লুথার কিং কি তাঁর হত্যা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন?
পঞ্চাশ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং এক সমাবেশে তাঁর জীবনের শেষ ভাষণ দিয়েছেন। তিনি কি সেই ভাষণে তাঁর হত্যা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন?
পঞ্চাশ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং এক সমাবেশে তাঁর জীবনের শেষ ভাষণ দিয়েছেন। তিনি কি সেই ভাষণে তাঁর হত্যা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন?
মার্টিন লুথার কিং মারা যাওয়ার আগের সপ্তাহে একটি বর্জ্য বহনকারী লরিতে করে তিনি মেমফিস পৌঁছেছিলেন।
এর দুই মাস আগে দুইজন কৃষ্ণাঙ্গ পরিচ্ছনতা কর্মী - একোল কোল এবং রবার্ট ওয়াকার- ঝড়ের সময় তাদের লরিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে লরির ভেতরে পিষ্ট হয়ে তারা মারা যান। তাদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে। এরপরই শহরের শতাধিক কৃষ্ণাঙ্গ কর্মী ধর্মঘট পালন করে।
আরো পড়ুন: ইতিহাসের সাক্ষী: আই হ্যাভ এ ড্রিম
চীনে কি গোপন সফর করছেন উত্তর কোরিয়ার কিম?
এপ্রিলের একটি ঝড়ো রাতে মার্টিন লুথার কিং যখন মেমফিসের মেসন টেম্পলের দুই হাজার মানুষের সামনে দাঁড়ান, সেটি ছিল কোল এবং ওয়াকার সহ আরো অনেক কৃষ্ণাঙ্গ কর্মীদের সমর্থনের উদ্দেশ্যে।
তবে তাঁর ভাষণ ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে ছিল না। ভাষণের ১১ মিনিট পর্যন্ত সেই ধর্মঘট নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। ভাষণের শেষ অংশটি ছিল ভবিষ্যদ্বাণীর মত।
"আমাদের সামনে কঠিন সময় আসছে, কিন্তু আমাকে তা আর প্রভাবিত করে না, কারণ আমি পর্বতের চুড়ায় আরোহণ করেছি এবং আমি আর কিছুই পরোয়া করি না।, উপস্থিত মানুষের উদ্দেশ্যে বলেন ড. কিং।
"অন্য যে কারো মত আমিও লম্বা সময় বাঁচতে চাই, জীবনের দৈর্ঘ্য মূল্যবান। কিন্তু সে বিষয়ে আর চিন্তিত নই আমি।"
"আমি শুধু ঈশ্বরের ইচ্ছাপূরণ করতে চাই. আর তিনি আমাকে পর্বতারোহণের ক্ষমতা দিয়েছেন। এবং আমি সেখান থেকে প্রতিশ্রুত ভূমি দেখতে পেয়েছি। "
"আমি সেখানে হয়তো আপনাদের সাথে যেতে পারবো না। তবে আমি আপনাদের জানাতে চাই, আমরা, একত্রিত স্বত্বা হিসেবে সেই প্রতিশ্রুত ভূমিতে যাব।"
"আজ আমি অত্যন্ত খুশী; আমি কোনোকিছু নিয়েই চিন্তিত নই; আমি আর কোনো মানুষের ভয় পাই না। আমি সৃষ্টিকর্তার আগমনীর জ্যোতি দেখেছি।"
এর পরের দিন ড. কিং তাঁর হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ডান গালে গুলিবিদ্ধ হন। বুলেটটি তাঁর চোয়াল ভেঙে মেরুদন্ডে আঘাত করে এবং শেষপর্যন্ত তিনি মারা যান।
ড. কিং কি জানতেন কি হতে যাচ্ছিল?
ভাষণ দেয়ার দিন সকালে ড. কিং বিমানে করে জর্জিয়ার আটলান্টা থেকে মেমফিসে আসেন। বিমানটি নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরীতে ছাড়ে।
পাইলট যাত্রীদের বলে, "বিলম্বের জন্য দু:খিত, কিন্তু প্লেনে ড. মার্টিন লুথার কিং আছেন।"
নিরাপত্তার খাতিরে সবকিছুই বারবার পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছিল।
পাইলট যাত্রীদের আরো বলেন, "আমরা প্লেনটি সারা রাত পাহাড়া দিয়ে রেখেছি।"
ড. কিংয়ের জীবনে সবসময় মৃত্যুর ছায়া লেগেই ছিল। মৃত্যু তাঁর পিছুপিছু ঘুরেছে সবসময়ই।
ড. কিং বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জোনাথন বলেন, "ড. কিং জানতেন লম্বা সময় যাবত শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী দলগুলো আর বিভিন্ন গুপ্তচররা তাঁকে অনুসরণ করছিল।"
"তিনি জানতেন অনেক মানুষই তাঁকে হত্যা করতে চায়। শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের বাহিনী অনেক মানবাধিকার কর্মীদের হত্যা করেছিল- এবং তিনি তাদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতনামা ছিলেন।"
১৯৬৫ সালে মন্টেগোমেরি বাস বয়কটের সময় ড. কিংয়ের বাসায় বোমা হামলা করা হয়।
১৯৫৮-তে নিউ ইয়র্কে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ কৃষ্ণাঙ্গ নারী তাঁকে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করে। ১৯৬৩ তে আলাবামার বার্মিংহামে মঞ্চের ওপর একজন শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীর আক্রমণের শিকার হন তিনি।
একবছর পর ঐ একই শহরে প্রচারণা চালাতে যান তিনি। অধ্যাপক রিয়েডার, যিনি ড. কিংয়ের বন্ধু অ্যান্ড্রু ইয়ং আর ওয়াইাট ওয়াকারের সাথে কথা বলেছিলেন, বলেন ড. কিং সফরের আগে তাঁদের সতর্ক করেছিলেন।
ড. কিং তাঁর বন্ধুদের বলেছিলেন, "আমরা বুল কনরের শহরে যাচ্ছি। এমনও হতে পারে আমাদের কয়েকজন সেখান থেকে বেঁচে নাও ফিরতে পারি।" (বুল কনর সেসময়কার নাগরিক অধিকার কার্যক্রম বিরোধী একজন স্থানীয় রাজনীতিবিদ ছিলেন)
ড. কিংয়ের কাজের ওপর সবসময়ই মৃত্যুর ছায়া ছিল। কিন্তু শুধু যে তিনি আর তাঁর সহকর্মীরাই মৃত্যুভয়ে থাকতেন তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ১৯৬০ এর দশক সংঘাতপূর্ণ, ভয়ঙ্কর একটি সময় ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে সেটি ছিল দাঙ্গা (হারলেম, ফিলাডেলফিয়া, লস অ্যাঞ্জেলস, ডেট্রয়েট), যুদ্ধ (ভিয়েতনাম) আর হত্যার (জন এফ কেনেডি, ম্যালকম এক্স, ড. কিং, রবার্ট এফ. কেনেডি) দশক।
১৯৬৩ সালে জন এফ কেনেডির হত্যার পর ড. কিং তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন "আমার ভ্যাগ্যেও এই আছে। আমি বারবার তোমাকে বলেছি, এটা অসুস্থ এক সমাজ।"
কিন্তু শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের সাথে কৃষ্ণাঙ্গদের ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব ড. কিংকে দুর্বল করে দিতে থাকে বলে বলেন অধ্যাপক রিয়েডার। মেমফিসের ভাষণের আগে ড. কিং "মানসিকভাবে দুর্বল" হয়ে পরেন বলে জানান মি. রিয়েডার।
মি. রিয়েডার বলেন, "রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ড. কিং যেমন সমাজের জন্য সংগ্রাম করছিলেন, আমেরিকান তৎকালীন সম্প্রদায় তার বিপরীত দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।"
"শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বেড়েছিল আমেরিকার উত্তরাঞ্চলে। দক্ষিণাঞ্চলের নেতা, আলাবামার গভর্নর, ড. কিংয়ের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী জর্জ ওয়ালেস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করছিলেন।"
"আদর্শগতভাবে তরুণ কৃষ্ণাঙ্গরা ও নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা ড. কিংয়ের প্রচার করা খ্রিস্টীয় অহিংস মতবাদ থেকে সরে যাচ্ছিল।"
একপর্যায়ে হতাশ হয়ে গেলেও ড. কিং আন্দোলন চালিয়ে যান।
তিনি অধিকার আদায়ের আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। সেই আন্দোলনের ধারা হিসেবেই মেমফিসের মেসন টেম্পলের এক ঝড়ো রাতে কৃষ্ণাঙ্গ কর্মীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ভাষণ দেন তিনি। তাঁর বয়স ছিল ৩৯ বছর।
অধ্যাপক রিয়েডার বলেন, "তিনি কয়েকদিন পরে তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন কি না সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু তিনি জানতেন যে মৃত্যু তাঁর পিছে ঘুরছে।"
মেমফিসের ঐ ভাষণের শেষদিকে ড. কিং ১০ বছর আগে নিউ ইয়র্কে ছুরিকাহত হওয়ার ঘটনা নিয়েও কথা বলেন।
তিনি বলেন সেদিন হাঁচি দিলে তিনি মারা যেতেন। আর তাহলে তাঁর দেখা হোতো না নাগরিক অধিকার বিল, 'আই হ্যাভ এ ড্রিম' ভাষণ, সেলমা আন্দোলনসহ আরো অনেক অবিস্মরণীয় মুহুর্ত।
মেমফিসের মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি সেদিন বলেন, "আমি খুবই খুশী যে সেদিন আমি হাঁচি দেইনি।"
কাজেই তাঁর শেষ কথাগুলো তাঁর আসন্ন মৃত্যুর সম্ভাবনা বা অনুমান সম্পর্কে আলোকপাত নয়। পরবর্তী প্রজন্মের হাতে বিপ্লবের দায়িত্ব হস্তান্তরের একটি প্রচেষ্টা ছিল এটি।
অধ্যাপক রিয়েডারের ভাষ্যমতে, "তিনি বলেছেন আমি যদি অর্জনে নাও থাকি, আমরা একসাথে এটা অর্জন করবো।"
"তিনি নিশ্চয়তা দেন যে তিনি বেঁচে না থাকলেও কৃষ্ণাঙ্গরা একাত্ম হয়ে আন্দোলন সফল করবে। "
"মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতিকালে তিনি হতাশাগ্রস্ত ছিলেন না। ঐ ভাষণের শেষ কথা দিয়ে তিনি আন্দোলন এবং নিজের জন্য সমাধিস্তম্ভ তৈরী করেছে।"
"পুরো ভাষণে যে বার্তা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে তা হোলো আমাদের গর্বিত হওয়ার অনেক কিছু আছে। আমার মতে, তিনি বলতে চেয়েছেন, আমি যদি মারাও যাই, আমার জীবন নিয়ে আমি খুশী। আমাদের প্রতিশ্রুত ভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রার পথে আমি আমার দায়িত্ব পালন করে গেলাম।"
আরো পড়ুন:
'ধূমপায়ী’ বন্য হাতিকে ঘিরে বিজ্ঞানীদের বিস্ময়
গায়ের রংয়ের ওপর নাগরিকত্ব দেয়া হয় যে দেশে
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: যে লেখা পাল্টে দেয় ইতিহাস