বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে সমস্যাটা কোথায়?
বাংলাদেশের গত এক দশক ধরে ঢাকার শেয়ার বাজার উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
সর্বশেষ এ সপ্তাহে বড় আকারের দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আবারো সংশয় তৈরি হয়েছে শেয়ার বাজার নিয়ে।
পুঁজি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যদিও বলছে বাজারে এ ধরণের উত্থান-পতন স্বাভাবিক একটি বিষয়, কিন্তু বিনিয়োগকারী এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ার বাজারে অস্থিরতার বিষয়টি যেন বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুঁজি হারিয়েছেন অনেকে
আতাউল্লাহ নাঈম ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে একজন বিনিয়োগকারী।
বাংলাদেশে ১০ বছর আগে শেয়ার বাজারে যে বড় দরপতন হয়েছিল, তখন বড় আকারের পুঁজি হারিয়েছিলেন মি. নাঈম। সে ধাক্কা এখনো সামলে নিতে পারেননি তিনি।
তখন যারা বড় আকারে পুঁজি হারিয়েছিলেন, তাদের বেশিরভাগের অবস্থা আতাউল্লা নাঈমের মতো।
"যাদের অনেক বড় ব্যালেন্স ছিল, তারা হয়তো কিছুটা সমন্বয় করেছেন। কিন্তু ঐ জায়গাটা পোষানোর কোন সুযোগই ছিল না। আশায় থাকতে থাকতে তারা নি:স্ব হয়ে গেছেন," বলেন আতাউল্লাহ নাঈম।
ঢাকার শেয়ার বাজারে গত একযুগ ধরেই চলছে উত্থান পতন। বাজারের পতন নিয়ে বিভিন্ন সময় বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন সময় রাস্তায় বিক্ষোভও করেছেন।
বাজার পরিস্থিতি কখনো কিছুটা ভালো হয়, আবার কিছুদিন পরেই মুখ থুবড়ে পড়ে। সূচক যখন নিচের দিকে নামতে থাকে তখন সেটি নামাতেই থাকে।
সর্বশেষ বড় আকারের দরপতন হয়েছে এ মাসেই।
বিবিসি বাংলায় আরো পড়তে পারেন:
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে অস্থিরতার কারণ কী
শেয়ারবাজারে ও তেলের মূল্যে ধস বিশ্বমন্দার পদধ্বনি?
শেয়ার বাজারে মানুষ টাকা বিনিয়োগ করে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর মাধ্যমে।
প্রতিটি লেনদেনে এসব হাউজ কমিশন পায়। অর্থাৎ যত বেশি লেনদেন হয় ব্রোকারেজ হাউজগুলোর তত বেশি লাভ।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং একটি ব্রোকারেজ হাউজের কর্ণধার শাকিল রিজভী বলছেন, শেয়ার বাজারকে অনেকে উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে মনে করছেন। এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গিও একটি বড় সমস্যা তৈরি করছে।
মি. রিজভী বলেন, "ধরেন কারো ১০ লাখ টাকা আছে। সে মনে করে শেয়ার বাজারে খাটিয়ে মাসে এক লাখ টাকা আয় করবে এবং তার সংসার চালাবে। অল্প টাকা নিয়ে লোন করে যারা আসে তাদের জন্য খুবই ডিফিকাল্ট।"
সবাই লাভ দেখে, ঝুঁকি দেখে না
২০১৩ সালে বাজারে অস্বাভাবিক দরপতন হলে তখন থেকে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিয়ে আসছে।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীর একটা বড় অংশই ঋণ নির্ভর। শেয়ার বাজারে অস্থিরতার বড় একটি কারণ হচ্ছে এই ঋণ নির্ভরতা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে শেয়ার বাজারে যারা টাকা খাটায় - তাদের সে অর্থে বিনিয়োগকারী বলা যায়না।
বিনিয়োগের সুফল পাওয়ার জন্য যে দীর্ঘমেয়াদী চিন্তাভাবনা থাকা দরকার সেটি অনেকেরই নেই।
এর ফলে বাজার নিম্নমুখী হলে অনেকের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক হয়, যেটি সংকটকে আরো গভীর করে তোলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষক এবং গবেষক পল্লবী সিদ্দিকা বলছিলেন, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকি সম্পর্কে অনেকে ভাবনে না। তারা শুধু লাভের বিষয়টি মাথায় রাখে।
পল্লবী সিদ্দিকা বলেন, "ইনভেস্টমেন্ট করতে গেলে রিস্ক একটা কমন ফ্যাক্টর। দরপতনের কারণে কী ধরণের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে সেটি অনেকে বিবেচনা করেনা। তারা শুধু লাভটুকুই দেখে।"
তিনি বলেন, পরিবারের ব্যয় নির্বাহের জন্য টাকার সংস্থান নিশ্চিত হবার পরেই শুধু শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা উচিত। কারণ এটি দীর্ঘমেয়াদী একটি বিষয়।
গুজবের পেছনে ছোটেন অনেকে
ঘনঘন অস্থিরতার পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে নানা ধরণের গুজব ও ভুল তথ্য।
সর্বশেষ ব্যাপক দরপতনের কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ বলছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব বাজার যে অস্থিরতা, এ নিয়েও ঢাকার শেয়ার বাজারে নানা গুজব ছড়ানো হয়।
বিভিন্ন সময় নানা ধরণের গুজব বিনিয়োগকারীদের নানাভাবে অস্থির, উদ্বিগ্ন এবং আতঙ্কিত করে তোলে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, পুঁজি বাজারে কেমন বিনিয়োগ হচ্ছে এবং কী ধরণের শেয়ার কেনা-বেচা হচ্ছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কিন্তু একই সাথে গুজবের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে গুজব একটি ভূমিকা রাখে।
পৃথিবীজুড়ে যে কোন ধরণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে গুজব বা নানা ধরণের উড়ো খবর আসে। সেগুলো শেয়ার বাজারকে প্রভাবিত করে বলে উল্লেখ করেন ফাহমিদা খাতুন।
শেয়ার বাজার সংশ্লিষ্ট এবং বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এবং ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারের তুলনায় স্টক মার্কেট বড় হয়নি।
অনেক কোম্পানি তাদের মূলধন জোগাড়ের জন্য স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্ত করেনা। টাকার জন্য তারা ব্যাংক ঋণের উপর বেশি নির্ভর করে।
নতুন নতুন কোম্পানি না আসায় বাজারের আকারও প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক চেয়ারম্যান শাকিল রিজভী বলছেন, নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির সংখ্যা যদি প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়তো তাহলে বাজার পরিস্থিতিও ভিন্ন রকম হতে পারতো।
শেয়ার বাজার নিয়ে কারসাজি রয়েছে?
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে কারসাজির অভিযোগ বেশ পুরনো। তবে শেয়ার বাজারে বড় আকারের কেলেঙ্কারি ঘটে ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে।
বিনিয়োগকারীদের অনেকই মনে করেন শেয়ারবাজারে বড় ধরণের উত্থান-পতনের পেছনে একটি মহলের কারসাজি রয়েছে।
১৯৯৬ সালে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
কিন্তু সেসব মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। শুধু একটি মামলায় ট্রাইব্যুনাল দুজনকে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল।
২০১০ সালে শেয়ারবাজারে বড় ধরণের পতনের পর এর কারণ অনুসন্ধানের জন্য সরকার একটি তদন্ত কমিটির গঠন করেছিল, যার প্রধান করা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে।
মি. খালেদ তখন বেশ পরিষ্কার করেই বলেছিলেন যে একটি মহলের কারসাজির কারণে শেয়ার বাজারে বিপর্যয় হয়েছিল। যদিও সরকার সে তদন্ত রিপোর্ট শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করেনি।
সে ঘটনায় যাদের নামে অভিযোগ উঠেছিল তাদের সবাই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারো বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি।
২০১০ সালের ঘটনায় দুটি মামলাও হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর কোন অগ্রগতি নেই।
অভিযোগ রয়েছে ১৯৯৬ সালের ঘটনায় যারা অভিযুক্ত ছিলেন, তাদের অনেকেই ২০১০ সালের শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিতেও জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
বারবার এ ধরণের ঘটনা ঘটায় শেয়ার বাজার একটু পড়তির দিকে গেলেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয় এবং তারা পুরনো কারসাজির গন্ধ খুঁজে পান।
অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলছিলেন, অধিকাংশ বিনিয়োগকারী বাজার সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই এবং তারা শেয়ার নিয়ে পর্যালোচনাও করেন না। এর ফলে নানাভাবে কারসাজি করা সম্ভব হয়।
"বড়রা যেমন সুযোগ নিতে চায়, তেমনি ছোটরাও সুযোগ নিতে চায়। কিন্তু ছোটদের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো তাদের এতো কম পুঁজি থাকে যে সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে আর কিছুই থাকে না," বলেন ফাহমিদা খাতুন।
ক্ষতিগ্রস্তদের সামাজিক সমস্যা
বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টে বলা হয় ২০১০ সালে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ করা হয়।
এর ফলে ৩০ লাখের বেশি মানুষ তাদের পুঁজি হারিয়েছিলেন।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে নি:স্ব হওয়া কিংবা বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়ার বহু ঘটনা রয়েছে।
এর একটি বড় প্রভাব পড়ছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর উপর। বিনিয়োগকারী আতাউল্লা নাঈম বলছিলেন তার জীবনেও এ ধরণের প্রভাব পড়েছে।
তিনি বলেন, "আমাকে যখন সবাই নি:স্ব হিসেবে ট্রিট করবে, তখন আমি সামাজিকভাবে অন্যদের কাছে আস্থা হারিয়ে ফেলবো। কেউ আমার সাথে লেনদেন করতে চাইবে না।"
বাংলাদেশে পুঁজি বাজারে টানা কয়েকদিনের দরপতনের মুখে এই বাজারে জরুরি ভিত্তিতে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
পুঁজি বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন মঙ্গলবার এক জরুরি বৈঠকের পর পুঁজি বাজার স্থিতিশীলতা তহবিল থেকে এই অর্থ ছাড় করেছে।
এছাড়া দরপতন ঠেকাতে শেয়ারের মূল্য পতনের নতুন সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এই সীমা অনুযায়ী, কোন শেয়ারের দাম সর্বোচ্চ দুই শতাংশ কমানো যাবে এবং বাড়ানো যাবে ১০ শতাংশ পর্যন্ত।
সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অন্যতম কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, তারা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখছেন।
"কিছু গুজবের কারণে কয়েকদিন ধরে শেয়ারবাজারে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে উত্তরণের জন্য এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাতে তাদের শেয়ার কম দামে বিক্রি করে দিয়ে অন্য কারও লাভের সুযোগ সৃষ্টি না করে, সেজন্য আমরা প্রথমত শেয়ারের মূল্য পতনের নতুন সীমা ঠিক করে দিয়েছি," বলেন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ড. আহমেদ।
পুঁজি বাজারের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা বিনিয়োগ করতে আসছেন তাদের দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা নিয়ে আসতে হবে এবং কোন কোন গুজবে কান না দিয়ে বাজার পর্যালোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাহলে বাজারও স্থিতিশীল থাকবে।
বিবিসি বাংলায় আজকের আরো খবর:
লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি কি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়াচ্ছে
ভ্লাদিমির পুতিনের কী যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার সম্ভব?
কিয়েভের কাছে অবস্থান নিচ্ছে রুশ সেনাবহর
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তুরস্কের ভূমিকা আসলে কী
কিডনির অসুখ সম্পর্কে খালি চোখে বোঝার কোন উপায় আছে?