যখন আমরা 'অক্ষম' বুড়ো হয়ে যাবো, তখন কী হবে?
পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে প্রবীণদের প্রতি আচরণের পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু এখনকার তরুণরা যখন প্রবীণ হয়ে উঠবেন, তাদের ক্ষেত্রে কী ঘটতে যাচ্ছে?
''প্রথা অনুযায়ী বয়স্ক নারীদের আমি হত্যা করি। তারা সবাই নিহত হয়েছে এই বড় নদীর পাড়ে। কিন্তু তাদের দাফন করার জন্য আমি সেখানে অপেক্ষা করিনি। নারীরা আমাকে দেখে ভয় পেতো।''
এটা হচ্ছে প্যারাগুয়ের পূর্বাঞ্চলের অ্যাচে নামের আদিবাসী একটি সম্প্রদায়ের একজন ব্যক্তির বক্তব্য, যা তিনি নৃবিজ্ঞানী কিম হিল আর ম্যাগদালেনা হার্টাডোকে বলেছিলেন।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলছিলেন, দাদী বাড়ির ছোটখাটো কাজ এবং বাচ্চাদের দেখাশোনা করতেন।
কিন্তু যখন তিনি আর কোন কাজ করতে পারছিলেন না, তখন আর আবেগি হওয়ার দরকার নেই। নিষ্ঠুরভাবে মাথায় কুড়াল দিয়ে আঘাত করে তাদের হত্যা করা হতো।
তবে বয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে নিয়ম ছিল আলাদা। তাদের দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেয়া হতো এবং বলা হতো যেন আর ফিরে না আসে।
প্রবীণদের প্রতি আমাদের কী দায়িত্ব রয়েছে?
এটি মানবজাতির মধ্যে পুরানো একটি প্রশ্ন।
সেটার উত্তর: সমাজ ভেদে অনেকভাবে তা পরিবর্তিত হয়েছে।
আরেকজন নৃবিজ্ঞানী, জ্যারেড ডায়মন্ড বলছেন, এরকম রীতি শুধুমাত্র আচে সম্প্রদায়ের ভেতরেই রয়েছে, এমন নয়।
পাপুয়া নিউগিনির কুয়ালঙ সম্প্রদায়ের মধ্যে যখন একজন নারীর স্বামী মারা যায়, তখন তার ছেলের প্রধান দায়িত্ব হয়ে ওঠে মাকে গলা টিপে হত্যা করা।
আরো পড়ুন:
স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা 'দীর্ঘ রোগমুক্ত জীবন' নিশ্চিত করে
বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষের জন্যে কী করছে সরকার
কাজে টিকে থাকার লড়াইয়ে জিতলেন ১০২ বছরের বৃদ্ধ
চল্লিশের পর ধীরে হাঁটা 'দ্রুত বুড়ো হবার লক্ষ্মণ'
আর্কটিকে চুচচি তাদের সম্প্রদায়ের বয়স্ক মানুষদের উৎসাহিত করে যেন তারা তাদের নিজেদের হত্যা করে।
তাহলে পরবর্তী জীবনে অনেক ভালো পুরস্কার পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।
কিন্তু অন্য অনেক গোত্র পুরো আলাদা ধরণের ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। সেখানে তরুণরা বৃদ্ধদের কথা মতো পরিচালিত হয়, যাকে বলা হয় 'জিরোন্টোক্রেসি'।
অনেক ক্ষেত্রে এমনকি আশা করা হয় যে, তরুণরা খাবার চিবিয়ে দেবেন, যাতে বয়স্কা এবং দাঁতহীন পিতা-মাতারা সেগুলো সহজে খেতে পারেন।
আগে সাধারণভাবে একটি ধারণা করা হতো যে, যতক্ষণ আপনার দেহ পুরোপুরি অচল হয়ে না পড়ছে, ততক্ষণ কাজ করে যাবেন। কিন্তু সেই ধারণা আর সত্য নয়।
পেনশন
আমাদের অনেকেই আশা করি যে, একটি নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছে পেনশন পাবো, যা অতীতে আমরা যে কাজ করেছি, তার মূল্যায়ন।
অর্থাৎ এখন আমরা আর কাজ করবো না, কিন্তু অতীত কাজের স্বীকৃতি ভোগ করবো।
প্রাচীন রোমেও সৈনিকদের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু ছিল। আসলে 'পেনশন' শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ 'পেমেন্ট' থেকে।
কিন্তু শুধুমাত্র উনিশ শতকে এসে সেটা সেনাবাহিনীর বাইরের ছড়িয়ে পড়ে।
রাষ্ট্রব্যবস্থায় পেনশন প্রথম চালু হয় জার্মানিতে, ১৮৯০ দশকে, যা চালু করেছিলেন তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর অট্টো ভন বিসমার্ক।
কিন্তু বয়স্ক মানুষদের সেবা প্রাপ্তির বিষয়টি এখনো বিশ্বে একটি সমস্যা হয়েই রয়ে গেছে।
বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বয়স্ক মানুষ কোন পেনশন পায় না। আবার অনেকে এতো সামান্য অর্থ পেনশন হিসাবে পান, যা দিয়ে তাদের ভরণপোষণ চলে না।
অনেক দেশে তরুণ প্রজন্মকে এমনভাবে গড়ে তোলা হয় যে, আশা করা হয় একসময়ে তারা বয়স্কদের দেখভাল করবে।
কিন্তু সেই আশা পূর্ণ হওয়ার ব্যাপারটি অনেক সময় চ্যালেঞ্জ হিসাবে থেকে যায়।
অনেক বছর ধরে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক বার্তা দিয়ে আসছেন যে, পেনশন ব্যবস্থায় একটি সংকট তৈরি হতে যাচ্ছে।
সমস্যাটি আসলে ভৌগলিক।
অর্ধশতক আগে, ধনী দেশগুলোর একটি সংস্থায় অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থাভুক্ত (ওইসিডি) দেশগুলোর গড়পড়তা ৬৫ বছর বয়সী একজন নারী আরো ১৫ বছর বেঁচে থাকার আশা করতে পারতেন। এখন তারা আশা করতে পারেন বিশ বছর।
আবার এই সময়ের মধ্যে পরিবার প্রতি শিশু জন্ম হার এসব দেশে ২.৭ থেকে কমে ১.৭-এ নেমে এসেছে, অর্থাৎ নির্ভর করার মতো পরবর্তী প্রজন্মের সংখ্যা কমেছে।
এর অনেকগুলি প্রভাব রয়েছে, কিছু ভালো এবং কিছু খারাপ।
পেনশনের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা হলো-ভবিষ্যতে আরো অনেক বেশি মানুষ অবসর নেবে, কিন্তু তাদের সাহায্য করার জন্য নতুন করদাতাদের সংখ্যা কমে যাবে।
১৯৬০ এর দশকে একজন বয়স্ক পেনশনভোগীর বিপরীতে ১২জন করদাতা ছিলেন, এখন সেই সংখ্যা আটের নিচে। ২০৫০ সাল নাগাদ সেটি চারে নেমে আসবে।
সরকারি এবং বেসরকারি- উভয় পেনশন ব্যবস্থা যেকারণে এখন ক্রমেই ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।
চল্লিশ বছর আগে বেশিরভাগ আমেরিকান 'সংজ্ঞায়িত-সুবিধা' পরিকল্পনার ভেতরে ছিলেন, যার মানে হলো, আপনি নির্দিষ্ট করে জানবেন যে, অবসরগ্রহণ কালে আপনি কি কি সুবিধা পাবেন।
কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যা প্রতি দশজনে একজন। অর্থাৎ বেশিরভাগ সংস্থা আগের মতো সুবিধা দিচ্ছে না।
নতুন ধারা হলো 'সংজ্ঞায়িত-অবদান' স্কিম, যার মানে হলো আপনি অবসরের পরে কতটা পাবেন, তার বদলে আপনি জানছেন যে, আপনার নিয়োগকর্তা আপনার পেনশন হিসাবে কতটা দেবেন।
এর কারণ হলো, পেনশনের পরে সুনির্দিষ্ট সুবিধাগুলো দিতে গেলে চাকরিদাতাদের জন্য বেশি ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে।
মার্কিন গৃহযুদ্ধের লড়াইয়ে জেন জেনওয়ের কেসটি বিবেচনা করা যায়।
তার সামরিক পেনশন অনুযায়ী তিনি মারা যাওয়ার পর তার একজন পোষ্য পেনশন সুবিধা পাওয়ার কথা।
যখন তার ৮১ বছর বয়স, তখন তিনি ১৮ বয়সী এক তরুণীকে বিয়ে করেন।
মার্কিন সেনাবাহিনী ২০০৩ সাল পর্যন্ত তার বিধবা স্ত্রীকে পেনশন সুবিধা দিয়েছে, যা গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় ১৪০ বছর পর পর্যন্ত।
অর্থনীতিবিদরা সামনে বিপদ দেখছেন।
কারণ অনেক কর্মী অবসরে যাবেন এবং তাদের পেনশন হয়তো তাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম হবে।
এ কারণে সারা বিশ্বের সরকার কর্মীদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে যেন, তারা নিজেদের জন্য আরো বেশি করে সঞ্চয় করেন।
কিন্তু দূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মানুষজনকে কাজ করানো সহজ নয়।
এক জরিপে দেখা দেখে, ৫০ বছরের নীচে অর্ধেকের কম মানুষ চিন্তা করে, অবসরের পরের অর্থনৈতিক ভাবনা তাদের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় নয়।
যখন কেউ প্রথম বাড়ি কেনার জন্য অর্থ সঞ্চয় করে কিংবা নতুন একটি পরিবার শুরু করে, তখন নিজের বয়স্ক ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ ভাবতে চায় না। হয়তো নিজেকে সেই বয়স্ক চেহারায় কেউ দেখতে চায় না।
অর্থনীতিবিদরা এই সমস্যার সমাধানে একটি 'চতুর' পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন।
সেটি হলো কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেনশন স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করা এবং পরবর্তী বেতন বৃদ্ধি থেকে আরো বেশি করে সঞ্চয় খাতে নিয়ে যাওয়া।
এই পদ্ধতি বেশ ভালো কাজ করেছে।
কিন্তু সেটা মৌলিক জনসংখ্যাগত সমস্যার সমাধান করছে না।
যত অর্থই সঞ্চয় করুন না কেন, বর্তমান পেনশনভোগীদের সুবিধা অব্যাহত রাখার জন্য তাদের বর্তমান কর্ম প্রবাহ চালু রাখতে হবে।
যারা নিয়মিত কাজ করে কর দেবেন, অবসর ভোগীদের সম্পত্তি ভাড়া নেবেন অথবা পেনশন তৈরি করা কোম্পানিগুলোয় কাজ করবেন।
অনেকে মনে করেন, বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন দরকার।
হয়তো অবসরের চিন্তার বদলে অতীতের মতো এখন এভাবে ভাবা উচিত যে, যতদিন কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে, ততদিন কাজ করে যাওয়া।
কিন্তু অতীত সমাজের ভয়াবহ রীতি আমাদের থমকে দেয়।
প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় তখন কি বয়স্করা আমাদের কাছে আশা করবেন যে, আমরা তাদের খাবার চিবিয়ে দেবো, নাকি নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে মাথায় কুড়াল মেরে তাদের বিদায় করা হবে?
কারণ আদিবাসী গোত্রগুলোর চিন্তা ছিল, বয়স্করা পরিবারে যে অবদান রেখেছে, তাদের ভরণপোষণের ব্যয় সেগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।
আচের মতো আদিবাসী গোত্রের কাছে সেই খরচ অনেক, কারণ খাদ্যের সন্ধানে তাদের প্রায়ই এদিক সেদিক ভ্রমণ করতে হয়।
সেই তুলনায় বর্তমান সমাজগুলো অনেক ধনী এবং ভালো অবস্থায় রয়েছে- ইচ্ছা করলে আমরা পেনশন বাড়ার খরচ বহন করতে পারবো।
কিন্তু সেখানেও কিছুটা জটিলতা রয়েছে।
যখন কেউ অবসরে যান, তখন তিনি জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং তরুণদের দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।
কিন্তু জ্ঞানের ধরণ পাল্টে গেছে- কারণ স্কুল আর উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট থাকতে কে আর দাদা-দাদীর কাছে শিখতে যায়?
এতোদিন পর্যন্ত বয়স্কদের ব্যাপারে যেভাবে ভাবা হতো বা দেখা হতো, হয়তো তার পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।
তবে আমরা যদি মর্যাদাপূর্ণ একটি বৃদ্ধ বয়স চাই, তাহলে সেটা নিয়ে এখনি ভাবা উচিত, সেটা পরিষ্কারভাবে বলা উচিত এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া উচিত।