চলে গেলেন নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী লেখক ভি এস নাইপল, রেখে গেলেন অসংখ্য বিতর্ক
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিতর্কিত লেখক ভি এস নাইপল শনিবার লন্ডনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। একদিকে যেমন তাঁর শক্তিশালী গদ্যের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন এই লেখক আবার তাঁর বিরুদ্ধে সমালো
শনিবার লন্ডনে নিজের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন নোবেল বিজয়ী ত্রিনিদাদের ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক ভি এস নাইপল। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর মতো খুব কম লেখকই ছিলেন যিনি একই সঙ্গে প্রশংসিত ও সমালোচিত হয়েছেন। তাঁর শক্তিশালী গদ্যের যেমন জবাব ছিল না, তেমনই একের পর এক বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি।
অবশ্য বিতর্ক নিয়ে তাঁর কোনওদিনই কোনও মাথা ব্য়াথা ছিল না, বরং তিনি বলতেন, 'কোনও লেখক যদি বিতর্কই তৈরি করতে না পারেন তাহলে বুঝতে হবে সেই লেখকের মৃত্যু হয়েছে।' বর্ণবিদ্বেষী, লিঙ্গবৈষম্যকারী, ইসলামবিরোধী - তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ কম ছিল না। তাঁর অবশ্য কোনও রাখঢাক ছিল না। জীবনীকার প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চকে তিনি খোলাখুলি জানিয়েছিলেন, বিবাহিত জীবনে পতিতাদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত মেলামেশা ছিল। জানিয়েছিলেন তাঁর রক্ষিতার উপর অমানুষিক অত্যাচার করার কথা, বলেছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছিলেন যে বলা যায়, 'আমি তাঁকে হত্যা করেছি'। তবে একথা স্বীকার করলেও এনিয়ে কখনও তাঁকে আফশোষ করতে দেখা যায়নি।
হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস
নিজের জীবনের বাস্তব ঘটনার সঙ্গে কল্পনার মিশেলে তিনি এক নতুন গদ্যরীতির সূচনা করেছিলেন। যা তাঁকে সেইসময়ের সব লেখকের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত উপন্যাস 'হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস'-ই প্রথম তাঁকে লেখক হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছিল। অক্সফোর্ড বিশববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি এই উপন্যাস রচনা করেছিলেন।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মোহন বিশ্বাস চরিত্রটিকে আলগাভাবে তাঁর পিতার অনুকরণে রচনা করেছিলেন নাইপল। নাইপলের বাবা ছিলেন ত্রিনিদাদের একজন সাংবাদিকয তবে তাঁরও মনে লেখক হওয়ার স্বপ্ন ছিল। উপন্যাসে মোহন বিশ্বাস নিজের একটা বাড়ি চেয়েছিল। সে মনে করত সম্পত্তিই তাঁকে নিরাপত্তা দেবে, দেবে ব্যক্তি স্বাধীনতা। বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর শসুরবাড়ির লোকেদের অনন্ত বিবাদের রসদ নইপাল পেয়েছিলেন তাঁর নিজের বাড়িতেই। এই রিয়েলিস্ট উপন্যাসটিকে অনে সমালোচকই বলেছেন ডিকেন্সিয়ান, কিন্তু নিজগুনে স্বতন্ত্র।
ত্রিনিদাদের সমালোচনা
প্রাথমিকভাবে নাইপলের লেখায় উঠে আসত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের সহজ জীবনের কথা। যেরকমটা দেখা গিয়েছিল স্যাম সেলভন জর্জ ল্যামিং বা ওয়ালকট-এর মতো ত্রিনিদাদের তৎকালীন লেখকদের মধ্যে। কিন্তু হাউস অব মিস্টার বিশ্বাসের পর থেকে নাইপলের লেখায় বর্ণিত ত্রিনিদাদের ছবিটা পাল্টে যায়। ১৯৬২-তে প্রকাশিত ট্রাভেলগ 'দ্য় মিডল পাসেজ-এ' নাইপল ত্রিনিদাদ সম্পর্কে লিখেছিলেন, 'গুরুত্বহীন, অসৃষ্টিশীল, রুঢ়প্রকৃতির।' সেখানকার সমাজের সমালোচনা করে বলেছিলেন, 'এমন এক সমাজ যার কোনও উৎবাদনশীলতা নেই, কখনও নিজের মূল্য বোঝাতে পারেনি এবং কখনই দক্ষ বলা যাবে না।'
পরে অবশ্য নাইপল বলেছিলেন আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় ক্রীতদাস ধরে আনার সময়ের কথা বলেছিলেন সেই গ্রন্থে। স্বীকার করেছিলেন তাতে অনেক খুঁত থেকে গিয়েছে। ত্রিনিদাদ ও তারর প্রতিবেশী দেশগুলির সমালোচনা যে বেশ কড়া হয়ে গিয়েছিল তাও মেনে নিয়েছিলেন। তবে, তাঁর লেখনির জবাব ছিল না। যে কারণে সমালোচকদেরও মন পেয়েছিল এই গ্রন্থ। যা তাঁকে পরবর্তীকালের আরও বেশ কিছু ট্রাভেলগ লেখার দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
ট্রাভেলগ এবং বিতর্ক
তাঁর ট্রাভেলগগুলি সমালোচকদের মতে বিপর্যয়ের কাটাছেঁড়া। তিনি নিজে বলতেন তাঁর ট্রাভেলগগুলি সেইসব সম্প্রদায়ের কথা বলে, যারা 'অর্ধসম্পূর্ণ' অথবা 'ক্ষয়িষ্ণু' এবং আগের ঔপনিবেসিক অপমানের বোঝা বয়ে চলেছে। ঘুরেছেন ভারত থেকে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান, ইরাণ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো অনেক দেশে। ভারত নিয়ে ১৯৫৪-তে লিখেছেন 'অ্যান এরিয়া অব ডার্কনেস', মুসলিম দেশগুলির অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর কলম থেকে বেরিয়েছে ১৯৮১-তে 'অ্যামং দ্য বিলিভার্স' এবং ১৯৯৮-তে 'বিয়ন্ড বিলিফ'।
এই ট্রাভেলগগুলি নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছেন সমালোচকরা। কেউ কেউ বলেছিলেন তাঁর লেখায় উঠে এসেছে সাম্রাজ্যবাদ ও নিপীড়নের সমালোচনা। আবার অন্য এক অংশ বলেছে তাঁর লেখায় রযেছে বর্ণবিদ্বেষ, বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায় নিয়ে তাঁর মতামতকে সমালোচকরা বলেছেন ঘৃণাভরা, সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারা।
বর্ণবিদ্বেষ ও লিঙ্গ বৈষম্য়ের সমালোচনা নিয়ে নাইপল
সমালোচনায় তিনি কখনই বিচলিত হননি, বরং তাঁদের কথায় বরাবর ইন্ধনই দিয়েছেন। আফ্রিকানদের সম্পর্কে বলেছিলেন, 'আফ্রিকানদের লাথানো উচিত কারণ ওরা শুধু সেটাই বোঝে।' ভারতীয় মহিলাদের কপালে টিপ পরা নিয়ে বলেছিলেন, 'মাথায় কিছু নেই, বোঝাতেই তারা টিপ পরে'। তিনি বলতেন, তাঁর আত্মায় এক শয়তানের বাসা আছে। সে মাঝে মাঝেই তাঁকে বইয়ে দেয়। যতই সমালোচনা হোক, তাঁর নিজের মতে উপন্যাসগুলির থেকে অনেক মূল্যবান ছিল এই ট্রাভেলগগুলি।
নাইপলের প্রথম জীবন
১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট ব্রিটিশ শাসিত ত্রিনিদাদের ছাগুয়ানায় এক হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন বিদিয়াধর সূরজপ্রসাদ নাইপল। উত্তরভারত থেকে চুক্তিভিত্তিক চাকরি নিয়ে ত্রিনিদাদে এসেছিলেন তাঁর ঠাকুর্দা। বাবা ছিলেন ত্রিনিদাদ গার্ডিয়ানের সাংবাদিক। মা ছিলেন ত্রিনিদাদের পড়নত অবস্থার এক উচ্চ শ্রেনীর জমিদারের ঘরের মেয়ে। তাঁর পরিবারের সঙ্গে নইপালের বাবার নিরন্তর ঝামেলাই হাউস অব মিস্টার বিশ্বাসের ভিত গড়ে দিয়েছিল।
নাইপল ভক্ত ছিলেন মলিয়ের, ইশপ সিরানো দে বেজারাক প্রমুখ লেখকের। কিন্তু তাঁর নিজের লেখারস্টাইলে এঁদের থেকে বেশি করে ধরা পড়েছে তাঁর বাবার সাংহাদিকের চোখ। পোর্ট অব স্পেনে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে ভি এস আসেন অক্সফোর্ডে ইংরাজী সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতে। ১৯৫৩ সালে স্নাতক হল সেখান থেকে। ১৯৭৫ সালে ক্যারিবিয়ান বিপ্লব নিয়ে তিনি লিখেছিলেন 'গেরিলাস'। সেই উপন্যাসই প্রথম তাঁকে বানিজ্যিক সাফল্য এনে দিয়েছিল।
ব্যক্তিগত জীবন ও লিঙ্গবৈষম্য
১৯৭২ সালে তাঁর প্রথম আর্জেন্টিনা সফরে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল মার্গারেট গুডিং-এর। বিবাহিত তিন সন্তানের মা, সেই অ্যাংলো-আর্জেন্টিনিয়ান মহিলার সঙ্গে তাঁর একটি স্য়াডোমাসোচিস্টিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইংল্যান্ডের বাড়িতে স্ত্রী প্য়াট্রিশিয়া হেলকে ফেলে মার্গারেটকে নিয়ে নাইপল বেরিয়ে পড়েন বিশ্বভ্রমণে।
তবে দুই নারীর উপরই তিনি অত্যাচার চালানোরর কথা নিজে মুখেই স্বীকার করেছিলেন। জানিয়েছিলেন মার্গারেট গুডিং-এর সঙ্গে অন্য এক পুরুষের সামান্য সম্পর্কের কথা জেনে তিনি টানা দুদিন ধরে তাঁকে প্রহার করেছিলেন। জনসমক্ষে য়াতে না বের হতে পারবেন না এরকম অবস্থা করে ছেড়েছিলেন।
ভি এস জানিয়েছিলেন বিয়ের এক বছরের মাথাতেই স্ত্রী প্য়াট্রিশিয়াকে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে তিনি যৌনসুখ পান না। নাইপলের কথায়, 'আমি মুক্তি পেয়েছিলাম, সে ভেঙে পড়েছিল'। ২৪ বছর ধরে একবার প্যাট্রিসিয়া একবার মার্গারেটে - এভাবেই চালিয়েছিলেন এই নোবেলজয়ী লেখক।
১৯৯৫ সালে ক্যানসারে মারা যান প্যাট্রিসিয়া। তাঁর মৃত্যুর দুমাসের মধ্য়ে মার্গারেটের সঙ্গে সম্পর্কও চুকিয়ে দেন নইপাল। বিয়ে করেন পাকিস্তানি সাংবাদিক নাদিরা আলভিকে। সেষ অবধি আলভিই ছিলেন তাঁর সঙ্গী।
পুরষ্কার ও সম্মান
সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য অসংখ্য সম্মান পেয়েছেন নাইপল। ২০০১ সালে তাঁর লেখায় 'অবদমিত ইতিহাস' উঠে আসার জন্য তাঁকে সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মান নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালেই 'ইন আ ফ্রি স্টেট' গ্রন্থের জন্য পেয়েছিলেন ম্যান বুকার পুরষ্কার। আর ১৯৯০ সালে ইংল্যান্ডের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। যে কারণে তাঁকে ডাকা হত ভিদিয়া বলে। তাঁর সঙ্গে যতই বিরোধিতা থাক তাঁর মৃত্যুর পর লেখক সলমান রুশদি বলেছেন, তাঁর মনে হচ্ছে 'বড় দাদাকে হারালাম'। অমিতাভ ঘোষও তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করেছেন।
We disagreed all our lives, about politics, about literature, and I feel as sad as if I just lost a beloved older brother. RIP Vidia. #VSNaipaul
— Salman Rushdie (@SalmanRushdie) August 12, 2018
RIP VS Naipaul. An old piece written when he won the Nobel: https://t.co/Mo8ZlX0Khi
— Amitav Ghosh (@GhoshAmitav) August 12, 2018
Sanjay Subrahmanyam's 'Where does he come from?' is well worth reading: https://t.co/IvC47iozs4