আমেরিকা ও রাশিয়া একই সময়ে ভারতকে খাতির করছে; বহুমুখী বিশ্বে সবই সম্ভব
ভারতের বিদেশনীতিতে একটি বেশ অভূতপূর্ব ঘটনা লক্ষ্য করা গেল সম্প্রতি।
ভারতের বিদেশনীতিতে একটি বেশ অভূতপূর্ব ঘটনা লক্ষ্য করা গেল সম্প্রতি। শুক্রবার, ১২ এপ্রিল একদিকে যেমন জানা গেল যে মার্কিন কংগ্রেসে ভারতকে 'নেটো জোটসঙ্গীদের' সমপর্যায়ে আনার জন্যে একটি বিল পেশ করা হয়েছে, অন্যদিকে ভারতে রুশ দূতাবাসের তরফে জানানো হল যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে মস্কোর তরফ থেকে 'অর্ডার অফ সেন্ট এন্ড্রিউ দ্য এপোস্টল' -- যা রাশিয়ার সর্বোচ্চ অসামরিক খেতাব -- সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। মোদীকে এই সম্মান জানানোর কারণ ভারত এবং রাশিয়ার মতো দুই পুরোনো মিত্রের সম্পর্কতে উন্নতি করতে বিশেষ অবদান রাখা।
এই দু'টি ঘটনাই ভারতের বিদেশনীতির পক্ষে ইতিবাচক।
একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার স্নেহভাজন? এ কিন্তু সহজ ব্যাপার নয়
আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে গেলে একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার বন্ধু হওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন পশ্চিম শিবির এবং সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন পূর্ব শিবিরের মধ্যে জোরদার ক্ষমতার লড়াইয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে গোটা দুনিয়া। রাজনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত, ইত্যাদি নানা নিরিখে সেই ঠান্ডা যুদ্ধ সময়ে সময়ে গরম হয়ে উঠলেও কপালজোরে দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ লাগেনি। আর এই সময়ে, দুই শিবিরের কোনওটিতেই নাম না লিখিয়ে একটি স্বতন্ত্র পথের খোঁজে নামে ভারত সহ কয়েকটি দেশ এবং তাদের হাত ধরেই তৈরী হয় নির্জোট আন্দোলন। যদিও এই নির্জোট আন্দোলনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখত এবং জোসেফ স্ট্যালিনও যে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন তা নয়। স্ট্যালিনের পরবর্তী নেতৃত্বের সঙ্গে অবশ্য ভারতের ভালোই বনিবনা হয় এবং বিভিন্ন সময়ে ভারত রাশিয়ার সহযোগিতা পায় -- রাজনৈতিক, সামরিক, বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
আমেরিকার আজ ভারতকে চাই, পাকিস্তান ওর চীনকে ঠেকাতে
ঠান্ডা যুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পায় এবং ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জঙ্গিহানার পরে এই মিত্রতা আরও দৃঢ় হয়। অন্যদিকে, মার্কিনিদের সঙ্গে তাদের পুরোনো বন্ধু পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে জটিলতা বাড়তে থাকে যার অন্যতম বড় কারণ আফগানিস্তান এবং তালিবান নিয়ে ওয়াশিংটন এবং ইসলামাবাদের স্বার্থের সংঘাত। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে যেই দু'টি দেশের স্বার্থ একই সরলরেখায় চলত, এখন তাই বদলে যায় আমূল। পাশাপাশি, চীনের উদ্বেগজনক উত্থানেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাবধান হয় যদিও বেজিং-এর সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক সর্বকালেই একই রকম উষ্ণ। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান এবং চীন দুই পক্ষকেই সামলাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন হয়ে পড়ে ভারতকে -- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৌশলগত নানা দিক থেকেই। আর তাই নানা নিষেধাজ্ঞা সত্বেও ভারত রাশিয়া থেকে এস-৪০০ অস্ত্র কিনলেও মার্কিনিরা শেষ পর্যন্ত মুখে কুলুপ এঁটেই থাকেন।
রাশিয়ারও আজ ভারতকে চাই; জাতীয় স্বার্থে
অন্যদিকে, দ্বিমুখী থেকে বহুমুখী আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাশিয়াও ভারতকে কাছছাড়া করতে রাজি নয়। যদিও বর্তমান সময়ে মার্কিন-ভারত ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির মতো রাশিয়া ও পাকিস্তানও একে অপরের কাছাকাছি এসেছে, কিন্তু মস্কো জানে পশ্চিম-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থা এবং চীনের মাতব্বরির মোকাবিলা করতে প্রয়োজন ভারতের মতো উদীয়মান শক্তিকেই। সাম্প্রতিককালে, ভারত রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন বা এসসিওতে হাত মিলিয়েছে। এই সংগঠনে চীনের একচেটিয়া প্রভাবের মোকাবিলা করতে রাশিয়ার প্রয়োজন ভারতকে। আবার পশ্চিম-প্রভাবিত বিশ্ব অর্থব্যবস্থার বিকল্প তৈরী করতে যে ব্রিকস নামক সংগঠনটি রয়েছে তাতেও চীন ওর রাশিয়ার সঙ্গে ভারতও রয়েছে। এই মঞ্চটি বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়ার পুনরুত্থানের জন্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানেও ভারতের সঙ্গে কাছাকাছি থাকা শ্রেয় মনে করেন ভ্লাদিমির পুতিন।
ভারতের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া দুই পক্ষের এই বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব দেখায় নয়াদিল্লির সামরিক প্রয়োজন এবং রাজনৈতিক ও কৌশলগত ভূমিকা তাদের কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে খুব বেশিবার এমন পরিস্থিতি আসেনি আর তাই পূব এবং পশ্চিমে একই সঙ্গে ভারতের এমন খাতির একটু বেশিই চোখকে ধাঁধাচ্ছে।