ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: সুইডেন-ফিনল্যান্ডকে নেটো জোটে নিতে অবশেষে তুরস্কের সমর্থন
সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের নেটো সামরিক জোটে যোগ দেয়ার প্রস্তাবকে অবশেষে সমর্থন দিয়েছে তুরস্ক।
প্রথমদিকে ওই দুই দেশের নেটো জোটে যোগ দেয়ার বিরোধিতা করেছিল দেশটি।
নেটো সামরিক জোটের নিয়ম অনুযায়ী, নতুন কোন সদস্য নিতে হলে জোটের সবগুলো দেশের সম্মতি থাকতে হয়। ফলে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে নেটো জোটে যোগ দেয়ার আগ্রহ জানালেও তুরস্কের আপত্তির কারণে তা আটকে গিয়েছিল।
তুরস্ক মনে করে, দেশ দুটি কুর্দি জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে।
ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের নেটো জোটে যোগ দেয়ার বিরোধী রাশিয়া। পশ্চিমা এই সামরিক জোট সম্প্রসারণ করতে চাইছে, এমন দাবি তুলে ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করেছিল রাশিয়া।
কিন্তু মস্কোর সেই অভিযান উল্টো ফলাফল দিতে শুরু করেছে। এতদিন নিরপেক্ষ দেশ হিসাবে থাকলেও ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর এখন নেটো জোটে যোগ দিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড।
বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্রাঙ্ক গার্ডনার বলছেন, দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে নেটো জোটে নেয়ার ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা অপসারণ হলো। ফিনল্যান্ড ও সুইডেন আধুনিক, গণতান্ত্রিক আর সুপ্রশিক্ষত সামরিক বাহিনীর অধিকারী দেশ হওয়ায় তা নেটোর উত্তরাঞ্চলে হুমকি মোকাবেলা শক্তিশালী করে তুলবে।
এই দুটি দেশ নেটো জোটে পুরোপুরি অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর বাল্টিক সাগরকে একটি নেটো লেকে পরিণত করবে, বলছেন গার্ডনার।
তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে তুরস্কের উদ্বেগের বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে।
নেটো মহাসচিব ইয়েন্স স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, সন্দেহভাজন জঙ্গিদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে পদক্ষেপ আরও জোরালো করার ব্যাপারে রাজি হয়েছে সুইডেন।
সেই সঙ্গে তুরস্কের কাছে অস্ত্র বিক্রির ওপর থাকা বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার বিষয়েও সম্মত হয়েছে নরডিক দেশদুটি।
ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট নিনিস্তো বলেছেন, তিন দেশ একটি যৌথ স্মারকে স্বাক্ষর করেছে যার মাধ্যমে 'একে অপরের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে হুমকি মোকাবেলায় পূর্ণ সহযোগিতা আরও বাড়ানো হবে।'
সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ম্যাগডালেনা অ্যান্ডারসন বলেছেন, 'এটা নেটোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।'
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তায়েপ এর্দোয়ানের দপ্তর বলেছে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের কাছ থেকে তারা যা চেয়েছে, 'সেটা পেয়েছে'।
কেন নেটোতে যোগ দেয়ার কথা ভাবছে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন?
সুইডেনসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর জনগণের মধ্যে নেটোর সামরিক জোটে যোগদানের জন্য কখনোই খুব বেশি সমর্থন ছিল না।
কিন্তু যখন রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সম্প্রতি ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনকে স্পষ্টভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, নেটোর সদস্য হওয়ার দিকে তাদের যেকোনো পদক্ষেপের পরিণতি হতে পারে সামরিক, তখন উভয় দেশের মানুষ গভীরভাবে মর্মাহত হয়।
তারপর থেকে, রুশ যুদ্ধবিমান নির্বিচারে সুইডিশ আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ করেছে।
দুই হাজার চৌদ্দ সালে রাশিয়ার একটি সাবমেরিন প্রবেশ করেছিল স্টকহোমের সীমানায়।
নিরপেক্ষ থাকাই যদি রাশিয়ার কাছ থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য যথেষ্ট না হয়, তবে হয়তো নেটোতে যোগ দিলে দেশ দুটি প্রয়োজনীয় সুরক্ষা পেতে পারে, বলছে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের জনগণ।,
ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট বৃহস্পতিবার বলেছেন, তার দেশের উচিৎ অবিলম্বে নেটো সদস্যপদের জন্য আবেদন করা।
রবিবার দেশটির পার্লামেন্টে অনুমোদনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে ঘোষণা আসতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার কাছে নিজেদের ১০ শতাংশ ভূমি হারালেও কোন জোটে যোগ দেয়া থেকে বিরত ছিল ফিনল্যান্ড।
কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড উত্তর ইউরোপের দেশগুলোকে আশঙ্কায় ফেলে দিয়েছে।
ফলে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলো নিজেদের অনিরাপদ ভাবতে শুরু করেছে।
ফিনল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার স্টাব বলেছেন, ২৪শে ফেব্রুয়ারি যখন রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করেছে, সেদিনই ফিনল্যান্ডের নেটোয় যোগ দেয়া হয়ে গেছে।
সুইডেনের ক্ষমতাসীন দলও এই সপ্তাহেই নেটোতে যোগ দেয়ার বিষয়ে ঘোষণা দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত নভেম্বরেও সুইডেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার হলৎভিস্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে সুইডেন কখনো নেটোতে যোগ দেবে না।
কিন্তু এখন তিনি বলছেন, যদি তারা নেটোতে যোগ দেন, তাহলে নরডিক দেশগুলোর নিরাপত্তা আরও জোরদার হবে।
অনেকে ফিনিশ এবং সুইডিশ মনে করেন, ইউরোপে এখন যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, নেটোতে যোগ দিলে তা থেকে তারা সুরক্ষা পাবেন।
তবে কম হলেও নেটোয় যোগ দেয়ার বিপক্ষে মনোভাবও রয়েছে একটি অংশের।
সুইডিশ পিস অ্যান্ড আরবিট্রেশন সোসাইটির সদস্য ডেবোরা সলোমন বলছেন, নেটোয় যোগ দিলে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক উত্তেজনা আর ঝুঁকি বাড়বে।
সেই সঙ্গে বিশ্বে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ আন্দোলনে সুইডেনের যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রয়েছে, তা হারাতে হবে।
নেটোয় যোগ দিলে বিশ্বে শান্তি রক্ষায় সুইডেনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও আর থাকবে না।
ফিনল্যান্ডের দিক থেকে দেখতে গেলে, ইউক্রেন আক্রমণের সাথে ১৯৩৯ সালের ফিনল্যান্ড আক্রমণের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে- যা দেশটিতে শীতকালীন যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ জোসেফ স্তালিন তার সেনাবাহিনীকে ফিনল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন শুধুমাত্র এটা প্রমাণ করতে যে, জেনারেলরা তাকে যে ধারণা দিয়েছিলেন তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা আসলে তার চেয়েও শক্তিশালী।
ফিনল্যান্ডের জনগণ তখন বিশাল এক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল।
ওই বাহিনীর মনোবল এক বছর বা তারও আগে গুরুতরভাবে ভেঙে পড়েছিল।
ওই বাহিনীর বেশিরভাগ শীর্ষ ব্যক্তিত্বের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে।
আলোচনা শুরু হওয়া এবং একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর আগে 'শীতকালীন যুদ্ধ' কয়েক মাস ধরে চলেছিল।
সেসময় রাশিয়া ফিনল্যান্ডের কাছ থেকে কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়।
কিন্তু ফিনিশরা তাদের স্বাধীনতা হারায়নি- এবং তখন থেকে তারা এটি এখনো ধরে রেখেছে।
নেটো কী?
নেটো- নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন হচ্ছে একটি সামরিক জোট।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১২টি দেশ মিলে এই জোট গঠিত হয়, যার মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স।
নেটোর কোন সদস্য আক্রমণের শিকার হলে অন্য সদস্য দেশগুলো তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে।
এই জোট মূলত তৈরি হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে রাশিয়ার বিস্তার ঠেকানোর উদ্দেশ্যে।
নেটোর পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে পূর্ব-ইউরোপের বামপন্থী দেশগুলোকে নিয়ে ১৯৫৫ সালে নিজস্ব আরেকটি সামরিক জোট গঠন করে সোভিয়েত রাশিয়া, ওয়ারশ প্যাক্ট নামে যা পরিচিত।
সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৯৯১ সালে পতনের পর ওয়ারশ প্যাক্টের সাবেক সদস্য বেশ কয়েকটি দেশ পক্ষ পরিবর্তন করে নেটোতে যোগ দেয়।
এখন নেটোর সদস্য সংখ্যা সব মিলিয়ে ৩০।