সুন্দরবনে শুরু হচ্ছে বাঘ শুমারি: কিভাবে হয় ক্যামেরা ট্র্যাপিং?
বাংলাদেশের সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা জানতে ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে বাঘ শুমারি। কিভাবে হয় এই বাঘ শুমারি?
বাংলাদেশের সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা জানতে আজ বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে বাঘ শুমারি।
সুন্দরবনে বর্তমানে কতগুলো বাঘ আছে, ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতির এই শুমারির মাধ্যমে সেটাই বের করা হবে।
কিভাবে হয় এই বাঘ শুমারি? এত বিশাল একটি বনে, অনেকটা একইরকম ডোরাকাটা দেখতে বাঘগুলোকে কিভাবে সনাক্ত করা হয়?
বনবিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক আমির হোসাইন চৌধুরী বলছেন, ''ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সুন্দরবনে বাঘের মোট সংখ্যা বের করা হবে।''
ক্যামেরা ট্র্যাপিং বা ক্যামেরার ফাঁদ পেতে ছবি তোলার এই পদ্ধতির জন্য সুন্দরবনের কিছু জায়গা স্যাম্পল হিসাবে নিয়ে তিনটি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এসব ব্লকের ২৩৯টি পয়েন্টে ৪৭৮টি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। এসব ক্যামেরার সামনে দিয়ে বাঘ বা কোন প্রাণী চলাফেরা করলেই ছবি উঠবে। আগে পাগ-মার্ক বা পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে বাঘ গণনা করা হলেও, সেই পদ্ধতিতে ভুলভ্রান্তি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হতো। ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে এখন প্রায় সব দেশ অনুসরণ করে থাকে।
মি. চৌধুরী বলছেন, ''একজন মানুষের আঙ্গুলের ছাপের সঙ্গে আরেকজনের ছাপের যেমন মিল নেই, তেমনি একটি বাঘের ডোরাকাটার সঙ্গে আরেকটি বাঘের মিল থাকে না। ক্যামেরায় তোলা এসব ছবি সংগ্রহের পর কম্পিউটারের সফটওয়্যারে প্রতিটি বাঘ আলাদা করা যাবে। তখন ছবি ও তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই জানা যাবে সুন্দরবনে ঠিক কতগুলো বাঘ রয়েছে। এই কাজে বাংলাদেশ ও ভারতের বাঘ বিশেষজ্ঞরাও সহায়তা করবেন।''
কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি জানান, এর আগে সাতক্ষীরা ব্লকের ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন নমুনা হিসাবে সুন্দরবনের দুইটি ব্লকে ৪৭৮ বর্গকিলোমিটার জায়গা বেছে নেয়া হয়েছে। এসব ব্লকে আবার প্রতি দুই কিলোমিটার জায়গা নিয়ে ঠিক করা হয়েছে একেকটি গ্রিড, যেখানে দুইটি করে ক্যামেরা থাকবে।
সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে যে সোয়া ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার বন রয়েছে।
তিনি বলছেন, ক্যামেরায় একেকটি বাঘের হয়তো শতাধিক ছবি উঠতে পারে। সব মিলিয়ে হয়তো কয়েক হাজার ছবি উঠবে। এসব ছবি বিচার বিশ্লেষণ করে বাঘের সংখ্যাটি বের করা হবে।
আড়াই মাস ধরে ক্যামেরায় ছবি সংগ্রহের এই কর্মকাণ্ড চলবে। এজন্য সেখানে বন বিভাগের ৬০জন কর্মকর্তা কাজ শুরু করেছেন।
কিভাবে কাজ করে ক্যামেরা ট্র্যাপিং?
কর্মকর্তারা বনের গভীরে গিয়ে এমন সব জায়গায় ক্যামেরা স্থাপন করবেন, যেখান দিয়ে বাঘ চলাচলের সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রায় বারো ফুটের মতো বৃত্তাকার জায়গায় গাছপালা কেটে পরিষ্কার করে দুপাশে দুইটি খুঁটি পোতা হয়। সেই খুঁটিতে বাঘের আনুমানিক উচ্চতায় ক্যামেরা বসানো হয়। বৃত্তের চারপাশে থাকে জাল দিয়ে ঘেরা। বৃত্তটি এমনভাবে তৈরি করা হয় যে, কোন বাঘ বা কোন প্রাণী প্রবেশ করলেই সেটি ক্যামেরার সামনে পড়বে।
ক্যামেরার সামনে বাঘকে আকষর্ণ করার জন্য বৃত্তের মতো খালিকটা জায়গা পরিষ্কার করে সেখানে একটি ছোট্ট পাত্রে পানি রাখা হয়। আর একটি কাঠির মাথায় কাপড়ে বেধে রাখা হয় স্টিংক বম্বের দ্রবণ।
এই দ্রবণ থেকে অতিশয় দুর্গন্ধ বের হয়, অনেকটা পচা মাংসের মতো।
'এই দুর্গন্ধই হল ফাঁদের টোপ। বাঘ যেহেতু অতিশয় উৎসুক প্রাণী, সেহেতু এই দুর্গন্ধই তাকে ক্যামেরার সামনে টেনে আনবে'। একজন বন কর্মকর্তা বিবিসিকে জানিয়েছেন।
ক্যামেরাগুলোতে ক্যামোফ্লেজ রং করা।
ফুট-খানেক দীর্ঘ এবং ইঞ্চি-চারেক চওড়ার একটি বাক্সাকার যন্ত্র।
ক্যামেরাগুলো সারাক্ষণই চালু থাকে এবং লেন্সের সামনে কোনও নড়াচড়া ধরা পড়লেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি তোলে। প্রতি দশ মিনিটে একটি স্থিরচিত্র ও দশ সেকেন্ডের ভিডিও ধারণ করে ক্যামেরাটি। রাতের বেলায় ক্যামেরাটি ব্যাবহার করে ব্ল্যাক ফ্ল্যাশ, খালি চোখে এই ফ্ল্যাশের আলো দেখা যাবে না।
ছবিগুলো একটি মেমোরি কার্ডে রক্ষিত হয়।
বনকর্মীরা পাঁচ দিন পর পর এসব মেমোরি কার্ড থেকে ছবিগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে আসবেন। এ সময় তারা ব্যাটারি পাল্টে দেয়া বা ক্যামেরা মেরামতের দরকার হলে সেসব কাজ করবেন।
কর্মকর্তারা আশা করছেন, বড় কোন অঘটন না হলে এপ্রিল বা মে মাসের মধ্যে সকল তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। এরপর পুরো বছর ধরে এগুলোর বিশ্লেষণ চলবে।
সামনের বছর জানুয়ারি মাস নাগাদ এই গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
সর্বশেষ ২০১৫ সালে সুন্দরবনে বাঘ শুমারি করা হয়েছিল। সেই শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ১০৬টি বাঘ রয়েছে। তার আগের ২০০৪ সালের পাগ-মার্ক বা পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে হওয়া শুমারি অনুযায়ী বনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৩০টি।
বন সংরক্ষক আমির হোসাইন চৌধুরী বলছেন, ''সাধারণত একেকটি বাঘ এক এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় কমই যায়। একেকটি বাঘের এলাকা কমবেশি ২০ কিলোমিটার। অনেক সময় বয়সের কারণে হয়তো তারা এলাকা থেকে অন্য কোথাও যায় বা অল্পবয়সী বাঘ বয়স্কদের উচ্ছেদ করে। তা না হলে সাধারণত একটি বাঘ আরেকটি এলাকায় প্রবেশ করে না। তারপরেও কোন বাঘ এলাকা পাল্টালে সফটওয়্যারেই ধরা পড়ে যাবে।''
কিন্তু দুই দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশ ও সুন্দরবনের বাঘ কি এই শুনানিতে আলাদা করা যাবে?
মি. চৌধুরী বলছেন, ''সুন্দরবনের মাঝে রায়মঙ্গল নামের একটি বড় নদী আছে, যা দুই দেশের সীমান্ত হিসাবে কাজ করে। বাঘ সাধারণত এক কিলোমিটার বা তার কম প্রস্থের নদী পারাপার করে। এতবড় নদী পারাপার করার উদাহরণ কম। এই নদী পারাপারের একটি ঘটনার কথাই আমরা জানি যে, একবার ভারতের একটি বাঘ পার হয়ে বাংলাদেশে এসেছিল।''
তিনি জানান, খুব তাড়াতাড়ি ভারতের অংশেও বাঘ শুমারি শুরু হবে বলে তারা জানতে পেরেছেন।
হরিণ নিয়েও একটি শুমারি করেছে বাংলাদেশের বন কর্মকর্তারা, সেসব তথ্য এখনো বিশ্লেষণ চলছে।