বর্তমান সময়কে কি ইতিহাস মনে রাখবে আমেরিকা ও চিনের মধ্যে চলা দ্বিতীয় 'কোল্ড ওয়ার' হিসাবে
সাধারণ ধারণা ছিল যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিযোগিতা আর যার ফলে ভয়ানক মানবিক বিপর্যয় ঘটবে। কিন্তু এই করোনার প্রকোপই কী আসলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ? অদৃশ্য, পরাক্রমশালী এই কোভিড ১৯ নামক ভাইরাসই কী আসল অস্ত্র এই যুদ্ধের! উঠেছে প্রশ্ন। আর এই অস্ত্র ব্যবহার করেই কী বিশ্বে নিজেদের প্রভুত্ব বিস্তার করবে চিন?
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসছে?
এই বিশ্ব এর আগে দেখেছে দুটি বিশ্বযুদ্ধ। গতশতকের সেই দুই যুদ্ধে বিশ্ব বদলে গিয়েছে পুরোপুরি। এছাড়া প্রাণ হারিয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। এরপরই ২১ শতক শুরু হওয়ার কয়েক বছরের পরই শুরু হয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা। এনিয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী থেকে ব্যয়বহুল সিনেমা তৈরি হয়েছে।
বাণিজ্যযুদ্ধের মাঝে করোনা সংক্রমণ
এই করোনা মহামারী এমন এক সময়ে এসেছে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্যে পড়ে বিশ্ব বাণিজ্য হুমকির মুখে। মুক্ত বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ গুরুতর অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে এই মহামারীর জেরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এটিই সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক সময় সমগ্র বিশ্বের জন্য। অবশ্য বাণিজ্যযুদ্ধ ছাড়িয়ে এখন উত্তেজনা ছড়িয়েছে সীমান্তে, সমুদ্রে, সব স্থানেই।
এই সময়ক মনে রাখা হবে দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ হিসাবে
করোনা বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এরপর এই যুদ্ধ বা প্রকোব, যাই বলুন, তা ছড়িয়ে পড়ে জাপান, সাউথ কোরিয়াসহ এশিয়ার প্রায় সবকটি দেশে। এরপরই ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ছাড়িয়ে আফ্রিকা মহাদেশেও হানা দিল এটি। এরপর চিন ধীরে ধীরে হানা দিতে শুরু করল লাদাখ, দক্ষিণ চিন সাগরে। যা পরিস্থিতি তাতে যুদ্ধ যদি নাও হয় ইতিহাস এই সময়টাকে মনে রাখবে বিশঅবে দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ হিসাবে।
কবে শেষ হবে এই চাপানউতোর
যখন এই প্রকোপ শেষ হবে, তখন কী শুধু চিনই বীরদর্পে দাঁড়িয়ে থাকবে? এই প্রকোপ শুরু হওয়ার পর গোটা বিশ্বে ২৬ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত এই সংক্রমণে। আমেরিকা, যে কী না বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী দেশ, এই করোনার জেরে নুইয়ে পড়েছে। সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ এখন সেটি। এরপরই তালিকায় রয়েছে ব্রাজিল ও ভারত। চিনের প্রতিবেশী দেশ এখন করোনা আবহে দাবার ঘুঁটি হয়ে গিয়েছে। লাদাখ নিয়ে বাড়তে থাকা চাপানউতোরের মাঝেই আমেরিকা ভারতকে সমর্থন জানিয়েছে।
গালওয়ান সংঘর্ষ
গত ১৫ জুন লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় এক ভয়াবহ সংঘর্ষে ভারতের ২০ জন সৈনিক শহিদ হন। চিনের তরফেও মারা যায় কমপক্ষে ৩৫ জন সেনা। এরপরই শান্তিবার্তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে নিরন্তর আলোচনা চললেও উত্তেজনা কমার নাম নেই। তবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতকে নয়, লাদাখে এই উত্তেজনা সৃষ্টি করার পিছনে আমেরিকাকে বার্তা দেওয়াই মূল লক্ষ্য বেজিংয়ের।
ফোকাসে দক্ষিণ চিন সাগর
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, লাদাখে শান্তি ফেরাতে দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের উপর চাপ বাড়ানো একটি ভালো কৌশল। লাদাখ ও দক্ষিণ চিন সাগরের তো কোনও যোগ নেই। তবে কেন লাদাখের সঙ্গে বারবার মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলটিকে। যোগসূত্র একটাই, তা হল বাণিজ্য। সারা বিশ্বে যখন করোনা সংক্রমণে জর্জরিত তখন সীমান্তে উত্তেজনা তৈরিতে ব্যস্ত চিন। তবে শুধু ভারতের লাদাখ নয়, এই সময়ে প্রায় নিয়মিত ভাবে তাইওয়ানের আকাশসীমায় নিজেদের যুদ্ধ বিমান পাঠিয়েছে চিন। এই আবহেই আমেরিকা প্রশান্ত মহাসাগর ও তাইওয়ান প্রণালীতে নিজেদের রণতরী মোতায়েন করেছে।
চিনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও রণং দেহি মেজাজে আমেরিকা
একই ভাবে লাদাখে চিনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও রণং দেহি মেজাজে আমেরিকা। প্রসঙ্গত, বহুদিন ধরেই চিনের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সংঘাত চলছিল। এরপর করোনা পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি আরও খানিকটা যুদ্ধের দিকে ঘণীভূত হতে থাকে। এর থেকেই বিশেষজ্ঞদের মত যে আদতে চিন এই সব দেশের বিরুদ্ধে উত্তেজনা তৈরি করে ওয়াশিংটনে বার্তা পৌঁছাতে চাইছে। এর জবাবে অবশ্য আমেরিকার সাফ বার্তা, মার্কিন সেনা চিনের তরফে আসা চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে উপযুক্ত জায়গায় মোতায়েন থাকবে।
বাণিজ্যিক যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু
দক্ষিণ চিন সমুদ্র বিশ্বের ব্যস্ততম সামুদ্রিক বাণিজ্য রুট৷ এই পথ দিয়ে বার্ষিক ৩.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়৷ যার ফলে শুধুমাত্র ক্ষুদ্র প্রতিবেশী অঞ্চলগুলির উপর নয়, একাধিক দেশগুলির উপরও এই সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটের প্রভাব রয়েছে৷ এছাড়া পূর্ব চিন সাগরে চিনের দাবিতেও ঝামেলায় পড়েছে আমেরিকা। উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সঙ্গে চিনের ইয়েলো সমুদ্র ও পূর্ব চিন সমুদ্রের অর্থনৈতিক জোনগুলি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷ তার উপরে চিন জাপানের সেনকাকু বা ডিয়াওইউ দ্বীপগুলির উপর কর্তৃত্ব দাবি করে৷ এই এলাকার মাধ্যমে আন্তঃঅঞ্চল ও বিশ্ব বাণিজ্য হয়৷ যার ফলে চিনের এই এলাকার উপর কর্তৃত্ব দাবি একাধিক দেশের উপর প্রভাব ফেলছে।
যেকোনও সময়ে লাগতে পারে যুদ্ধ
যা পরিস্থিতি তাতে যেকোনও পক্ষ থেকে 'ভুল'বশে কোনও গুলি চললে তা আশ্চর্যের হবে না। ঠিক যেমন পরিস্থিতি ছিল আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যকার ঠান্ডা লড়াইয়ের সময়। আসলে ভারত ছাড়া বাকি সব দক্ষিণ এশিয়ার দেশের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে গিয়েছে চিন। এবং বাণিজ্য যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নাজেহাল করেছে এই সুপারপাওয়ার। এই আবহে আমেরিকার মিত্রদেশগুলির সঙ্গে এই উত্তেজনা সৃষ্টি আসলে আমেরিকাকে উত্তেজিত করা।