সমুদ্র মন্থনে বিশ্বের কাছে 'শিব' বোয়ান, সমুদ্র থেকে পাপ তোলার এক মহাযজ্ঞ শুরু করছেন তিনি
দেবতাদের অমৃত পান করাতে হয়েছিল সমুদ্র মন্থন। আর সেই সমুদ্র মন্থনে যে গরল বা বিষ উঠেছিল তা পান করেছিলেন শিব। নিজেকে কন্ঠক করেছিলেন দেবতাদের অমর করতে।
দেবতাদের অমৃত পান করাতে হয়েছিল সমুদ্র মন্থন। আর সেই সমুদ্র মন্থনে যে গরল বা বিষ উঠেছিল তা পান করেছিলেন শিব। নিজেকে কন্ঠক করেছিলেন দেবতাদের অমর করতে। বর্তমান সময়েও এমন এক শিবের সন্ধান মিলেছে। তাঁর নাম বোয়ান স্ল্যাট। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মহাসাগরের বুকে এক মহাযজ্ঞ শুরু করতে চলেছেন তিনি ও তাঁর দল। যাকে এই মুহূর্তে 'দ্য ওয়ার্ল্ড'স মোস্ট অ্যাম্বিসাস ওসন ক্লিনআপ' প্রজেক্ট বলা হচ্ছে।
কী এই 'দ্য ওয়ার্ল্ড'স মোস্ট অ্যাম্বিসাস ওসন ক্লিনআপ'? বিশ্বজুড়ে আজ বিভিন্ন ধরনের আবর্জনায় ভরে গিয়েছে সমুদ্র থেকে মহাসাগর। এইসব আর্বজনার মধ্যে নব্বই শতাংশ মানুষের ফেলে দেওয়ার অব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসপত্র। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে প্লাস্টিক। এইসব আবর্জনার স্তূপের আয়তন জানলে সকলেরই ভিড়মি খাওয়ার অবস্থা হবে। কারণ সমুদ্র ও মহাসাগরের বুকে ভাসমান এই আবর্জনার স্তূপের কারোর কারোর আয়তন একটা দেশের সমান বা তার থেকে বেশি। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে এই বিশালাকার আবর্জনার স্তূপ থেকে সাগরের জল থেকে আলাদা করা চাট্টিখানি ব্য়াপার নয়।
নেদারল্যান্ডসের নাগরিক বোয়ান স্ট্যালার ছোট থেকেই আর দশ-পাঁচটা ডাচ বালকের মতোই সমুদ্র সাঁতার কাটতেন। এমনকী, ডাইভিং তাঁর এতটাই পছন্দের যে নানা সময়ে বিভিন্ন দেশে নানা প্রতিযোগিতাতেও অংশ নিতেন। একবার গ্রিস উপকূলের কাছে সাঁতার কাটতে কাটতে বোয়ান আবিষ্কার করেন সমুদ্রে যত না মাছ তিনি দেখতে পাচ্ছেন তার থেকে বেশি আবর্জনা তাঁর নজরে আসছে।
সমুদ্র দূষণের এই চেতনাই পুরোপুরি বদলে দেয় বোয়ান স্ট্যালারের জীবন। মাত্র ১৬ বছর বয়স থেকে সমুদ্র দূষণরোধে কাজ শুরু করার শপথ নেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন বিশ্বজুড়ে সমুদ্র ও মহাসাগরে ৫ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিক ভেসে বেড়াচ্ছে। যার জন্য ফি বছর ১৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে বিশ্বের। ২০১৩ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে বোয়ান তৈরি করেন একটি অলাভদায়ক সংস্থা। যার নাম দেন 'দ্য ওসন ক্লিনআপ'। ৮ বছর ধরে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালানোর পর একটা মহা প্রকল্প তৈরি করেন বোয়ান ও তাঁর দল। বাস্তবের রূপ দেওয়া হয় 'দ্য ওয়ার্ল্ড'স মোস্ট অ্যাম্বিসাস ওসন ক্লিনআপ' প্রকল্পের।
null
null
বোয়ান ও তার দল বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে তৈরি করেছেন বিশালাকার 'প্যাসিভ ড্রিফটিং সিস্টেম'। প্লাস্টিক টিউবের ড্রিফ্টিং সিস্টেমকে গ্রাম-বাংলায় মাছ ধরতে ব্যবহৃত বড় জালের মতো করে বানানো হয়েছে। মানে বড় জাল দিয়ে যেমন চারদিক থেকে মাছেদের ঘিরে ফেলে তাদের একটা পয়েন্টে টেনে এনে বন্দি করা হয়, অনেকটা তেমনভাবেই কাজ করবে এই 'প্যাসিভ ড্রিফটিং সিস্টেম'।'প্যাসিভ ড্রিফটিং সিস্টেম'। এই 'প্যাসিভ ড্রিফটিং সিস্টেম'-এর যে টিউব জলের উপরে ভেস আছে তার সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে রাবারের পর্দা। যা অনেকটা স্কার্টের মতো কাজ করছে।
'প্যাসিভ ড্রিফটিং সিস্টেম'-এর পার্ট ওয়ান-এর নাম সিস্টেম ০০১। এটা ৬০০ মিটার লম্বা ফ্লোটার, যা জলের উপরে ভাসছে। আর এরসঙ্গে জলের নিচে জুড়ে রয়েছে ৩ মিটার লম্বা ডিপ স্কার্ট। ফ্লোটার জলের উপরে ভেসে থাকা আবর্জনাকে এর আটকে দেবে। আর অন্যদিকে জলের নিচে থাকা নোংরাকে বন্দি করবে ৩ মিটার লম্বা ডুবন্ত ডিপ স্কার্ট। এটাকে ইউ-আকারের মতো করে একজায়গায় আনা হবে। এরপর এই 'প্যাসিভ ড্রিফটিং সিস্টেম'-এর এলাকায় ঢোকানো হবে একটি ছোট জাহাজ। আরও একটি জাল দিয়ে আবর্জনা জাহাজে তুলে নেওয়া হবে। এভাবেই সমুদ্র থেকে আবর্জনা সাফ করার পদ্ধতি বের করেছেন বোয়ান।
এই বিশাল 'প্যাসিভ ড্রিফটিং সিস্টেম'-এর প্রথমা নিশানা প্রশান্ত মহাসাগরে ক্যালিফোর্নিয়া ও হাওয়াই দ্বীপের মাঝে ভাসমান বিশাল আবর্জনার স্তূপ। যার আয়তন অন্তত ১.৬ মিলিয়ন স্কোয়ার কিলোমিটার। আয়তনের আকার আরও ভালো করে বোঝাতে বলা যেতে পারে- এর আয়তন আমেরিকার টেক্সাস মহাদেশের সমান অথবা ফ্রান্সের ভূখণ্ডের ৩ গুণ।
null
null
এই আবর্জনার স্তূপ থেকে ৮০ কিলো টনস ওজনের প্লাস্টিক মিলবে বলে মনে করা হচ্ছে। যা একটা জাম্বো জেটের ওজনের সমান। এতে যে পরিমাণ প্লাস্টিক রয়েছে তার পরিমাণ ১.৮ ট্রিলিয় ববে দাবি করা হচ্ছে। এই 'প্যাসিভ ড্রিফটিং সিস্টেম'-পদ্ধতিকে নিখুত করতে বোয়ান এবং তাঁর দল স্রোত ও হাওয়াকে কাজে লাগাচ্ছে, অর্থাৎ তাঁরা স্রোত বা হাওয়ার বিপরীতে গিয়ে আবর্জনা সংগ্রহ করবে না। এতে কাজ আরও সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।