জনজীবন স্বাভাবিক রেখে সামাজিক দুরত্বকে হাতিয়ার করে লকডাউন ঘোষণা, ব্যর্থ সুইডিশ সরকার
জনজীবন স্বাভাবিক রেখে সামাজিক দুরত্বকে হাতিয়ার করে লকডাউন ঘোষণা, ব্যর্থ সুইডিশ সরকার
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আটকানোর জন্য এখন শুধুমাত্র বিশ্ববাসীর কাছে একটাই বিকল্প তা হল দীর্ঘসময়ের জন্য লকডাউন। ভারত সহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশ সেই পথেই পা বাড়িয়েছে এবং তাতে সাফল্যও দেখা দিয়েছে কিছুক্ষেত্রে। কারণ লকডাউনের অর্থ হল একটি শহরকে স্তব্ধ করে দেওয়া। তবে করোনা ভাইরাস রোধের মূলমন্ত্র সামাজিক দুরত্ব বজায়। এই সবকিছুর থেকে সুইডেন কিছুটা অন্য কৌশল নিয়েছে এই মারণ ভাইরাসকে জব্দ করার জন্য। এর আগে সুইডেনকে 'কম মাত্রাযুক্ত’ লকডাউন ও সামাজিক দুরত্বের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য প্রশংসা করা হলেও, এখন দেখা যাচ্ছে যে সুইডেনের এই পাল্টা পদ্ধতি জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পন্থা নাও হতে পারে।
জনজীবন স্বাভাবিক রেখে লকডাউনের ঘোষণা
যখন বেশিরভাগ প্রতিবেশি দেশগুলো স্কুল, ব্যবসা ও রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখছে এবং মানুষকে বাড়িতে থাকতে বলছে ও জমায়েত এড়িয়ে যেতে বলছে, সেখানে সুইডেন অন্য রাস্তায় হেঁটেছে। কোনও কঠোর ব্যবস্থা ছাড়াই শুধুমাত্র সামাজিক দুরত্বের ওপর নির্ভর করে দেশের জনজীবন স্বাভাবিক রেখেছে সরকার। এই দেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সবকিছু বন্ধ করে ও হঠাৎ একদিন পুনরায় চালু হলে, এই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে, তাই ‘কম মাত্রাযুক্ত' লকডাউন এ ক্ষেত্রে ভালো বিকল্প হতে পারে। সুইডেনের মহামারি বিশেষজ্ঞ অ্যান্ডার্স ওয়ালেনস্টেন এই কৌশল প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে জানিয়েছেন যে ধীরগতিতে সংক্রমণ হলে তা স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর বেশি চাপের সৃষ্টি করবে না। তিনি এ বিষয়ে তর্ক করে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে জনসংখ্যার একটি অংশের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা খুব জরুরি।
অপ্রত্যক্ষভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার কৌশল
মহামারি বিশেষজ্ঞের এই কৌশলের ধারণা হল অপ্রত্যক্ষভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা। যার অর্থ নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর একটা অংশ এই রোগে সংক্রমিত হলে, তাঁরা অন্য দুর্বল সদস্যদের রক্ষা করতে পারবে এবং এটি খুব বেশি ছড়াতে পারবে না। যদি সংক্রমণ বাড়ে তবে দেশের ১০.২ মিলিয়ন জনসংখ্যাকে রক্ষা করবে দেশের শক্তিশালী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা। অতীতের সপ্তাহগুলিতে যদিও সুইডেনে কোভিড-১৯-এর সংখ্যা বেড়েছে এবং ৭০০টি নতুন কেস ধরা পড়েছে ২৪ এপ্রিলে। তার মানে সুইডেনে মোট কেসের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ১৭,৫৬৭টি ও মৃত্যু হয়েছে ২,১৫৬টি।
সুইডিশ পদ্ধতি ব্যর্থ
ইউরোপের নরডেন দেশগুলির অপেক্ষায় সুইডেনে দ্বিগুণ সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। নরওয়ে (৭৪০১ টি কেস ও ১৯৫ মৃত্যু) ও ফিনল্যান্ড (৪৩৯৫টি কেস ও ১৭৭টি মৃত্যু) উভয় দেশই কঠোর লকডাউন জারি করেছিল দেশে। তবে ইতিমধ্যেই ফিন্যান্ডে সংক্রমণের হার হ্রাস পাওয়ার কারণে এই দেশ ধীরে ধীরে লকডাউনের পদ্ধতি আলগা করছে। সুইডেনে প্রতি মিলিয়নে মৃত্যু হয়েছে ১৯৮, যা জার্মানির (৬৭) থেকেও বেশি, এমনকী আমেরিকার (১৫২) থেকেও, যা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমিত দেশ। তাই প্রশ্ন উঠছে সুইডেনের কৌশল কি আদৌও কাজে দিল না তা দেশকে উল্টে বিপর্যয়ের মুখে ফেলল।
আত্মসংযম ও নিজের পছন্দ
সুইডিশ পদ্ধতির প্রধান বিষয় হল দেশটির স্বতন্ত্র স্বাধীনতার পাশাপাশি আত্মসংযমের উপর জোর দেওয়া। মার্চে এক সাক্ষাতকারে মহামারি বিশেষজ্ঞ আ্যাঙ্গুশ তেগনেল বলেছিলেন, ‘এভাবেই আমরা সুইডেনে কাজ করছি। স্বেচ্ছা পদক্ষেপের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের গোটা পদ্ধতি এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার কাজে লেগেছে। টিকাদানের পদ্ধতি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবী এবং ৯৮ শতাংশ কভারেজ হয়ে গিয়েছে।' সরকারি বার্তাগুলি সামাজিক দুরত্ব, হাত ধোওয়া ও ৭০ বছর বা উর্ধ্বে যাঁদের বয়স তাঁদের নিরাপদে রাখার ওপর জোর দিচ্ছে। সুইডিশ সরকার প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি স্কুল ও রেস্তোরাঁ খোলা রেখেছে। খোলা রয়েছে স্যাঁলো ও বিভিন্ন বাজারও।
সুইডিশ সরকার না ভেবেই আংশিক লকডাউন ঘোষণা করে
প্রথমদিকে তো ৫০০ জন মানুষের জমায়েতেও অনুমতি মিলত। কেবলমাত্র হাইস্কুল বন্ধ রাখা হয়ছিল এবং সকলকে বানিতে বসে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। সুইডিশ সরকার লকডাউনের সিদ্ধান্ত না নিলেও সুইডিশ জনজীবন থেকে দূরেও ছিল। গণ পরিবহন হ্রাস পেয়েছিল ৬০ শতাংশ এবং স্কাই রিসর্টগুলিও ফাঁকা পড়েছিল। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কৌশল অসংক্রমণহীন বাহকদের বিষয়ে ও প্রবীণ জনসংখ্যার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে তা সরকার বিবেচনা করেনি।
সুইডেনে এপ্রিল থেকেই সংক্রম বাড়তে শুরু করে
এপ্রিলে কোভিড-১৯-এর কেস ক্রমাগত বাড়তে শুরু করে দেয়। বিশেষ করে হাপাতালগুলিতে বয়স্কদের ভিড় বাড়তে থাকে। পরিসংখ্যান বলছে, এক-তৃতীয়াংশ হাসপাতালে অন্তত একটি করে করোনা কেস রয়েছে। মার্চ থেকেই হাসপাতালের আইসিইউতে কোভিড-১৯-এর কেস দ্বিগুণ হতে শুরু করে। ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত আইসিইউতে রয়েচে ১,২৪৪ জন রোগী। সুইডেনে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর হারও। এরপর সুইডিশ সরকার ফের নতুন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসে এবং বলে যে একটা সময়ে ৫০ জনের বেশি জমায়েত করা যাবে না। পরামর্শ দেওয়া হয়, রেস্তোরাঁতে দুরত্ব বাড়িয়ে বসানো হোক, আন্তর্জাতিক সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং হাসপাতালে সকলকে যেতে বলা হয়।
পূর্ণ লকডাউনের জন্য সরকারকে আবেদন শিক্ষাবিদদের
যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে এটি খুব বেশি দেরি করার মতো বিষয় নয়। কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের ছয় অধ্যাপক দ্বারা প্রবর্তিত ২,০০০ বিশেষজ্ঞ এবং শিক্ষাবিদদের নিয়ে গড়া রিসার্চ বডি মার্চেই সরকারকে কড়াভাবে লকডাউন জারি করার জন্য পিটিশন দেন। ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডও সংক্রমণ ও মৃতুর সংখআ বাড়তে দেখে তাগের সিদ্ধান্ত বদল করে। শিক্ষাবিদরা তাঁদেরপ চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমাদের হাতে এখনও সময় রয়েছে এই ভাইরাসকে দমন করার জন্য। আমাদের দেশ ইউরোপের থেকে ব্যতিক্রম নয়। আমরা আমাদের সরকারকে এখনি পদক্ষেপ করার জন্য অনুরোধ করছি।' যদিও দেশের মুখ্য মহামারি বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন যে এই কৌশল কাজ দিয়েছে আর দেশে করোনা সংক্রমণও অনেকটাই স্থিতিশীল। তাঁর দাবি আর দু'হপ্তার মধ্যেই অপ্রত্যক্ষভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে তাঁরা সফল হবে।
করোনা আবহে নতুন পদক্ষেপ পেটিএম মলের, গাঁটছড়া দশ হাজার ছোট দোকানের সাথে