মা হয়েও দুধের শিশুকে বাঁচাতে না পারার বেদনা, নিথর সন্তানের দেহ হাতে কেঁদে উঠল রোহিঙ্গা মা
উত্তাল সমুদ্রে জলে ডুবে মৃত্যু হল এক মাসের এক রোহিঙ্গা শিশুর। আবদুল মাসুদ নামে ওই শিশু এবং তার মা হানিদার ছবি এখন ভাইরাল হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বলা হচ্ছে ছোট্ট আবদুলের মৃত্যু খেয়াল করিয়ে দিচ্ছে আয়
খেয়াল পড়ে আয়লান কুর্দির কথা। এই সেপ্টেম্বর থেকে দু'টো বছর পিছনে চলে গেলেই হল। তাহলে স্মৃতির সরণি বেয়ে ফিরে আসবে আয়লান কুর্দি। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার দামাস্কাস অঞ্চলের তিন বছরের শিশু ছিল আয়লান কুর্দি। জীবনের খোঁজে মা-বাবার সঙ্গে রবারের বোটে চেপে উত্তাল সমুদ্রে পাড়ি জমিয়েছিল সে। পারে পৌঁছেছিল আয়লান। তবে তাকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন সমুদ্রের নোনা জলে সৈকতের ধারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল ছোট্ট আয়লানের দেহ। ভয়ানক সেই ছবি দেখে ডুকরে উঠেছিল বিশ্ব।
ছোট্ট আয়লানের মতোই বাঁচতে চেয়েছিল এক মাসের শিশু আবদুল মাসুদ। কারণ, অগাস্টের শেষ সপ্তাহ থেকেই জ্বলছে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে থাকা তাদের এলাকা। যে কোনও মুহূর্তেই চলে আসছে মায়ানমার সরকারের সেনাবাহিনী। হয় গুলি করে মারছে, না হলে বাড়ির বউ-মেয়েদের তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে। আতঙ্কে ঘুম আসছিল না এক মাসের আবদুল মাসুদের মা হানিদা বেগম ও তার বাবার। তাই ভিটে-মাটি ছেড়ে পালানো অন্য রোহিঙ্গাদের দলে নাম লিখিয়েছিলেন ছোট্ট আবদুলের মা-বাবাও।
পালিয়েও যেন নিস্তার নেই। কারণ, পিছনেও যেন ধাওয়া করে আসছে সরকারি সেনাবাহিনী। ধরা পড়লে যে কোনও মুহূর্তেই সরকারি গুলির সামনে কুকুরের মতো মৃত্যুবরণ করতে হতে পারে। তাই সাত তাড়াতাড়ি না ভেবেই উত্তাল বঙ্গোপসাগরের উপরে একটি কাঠের নৌকায় চেপে বসেছিলেন আবদুলের মা হানিদা এবং তার বাবা। সঙ্গে ছিল আবদুলের থেকে সামান্য বড় তার এক দিদি। ক্ষমতার থেকেও বেশি যাত্রী নিয়েই বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল নৌকাটি। আসলে এরা সকলেই রোহিঙ্গা মুসলিম। প্রাণ বাঁচাতে তখন প্রত্যেকেই এক চিলতে কাঠের নৌকাকে আঁকড়ে ধরেছে।
বাংলাদেশের শাহ পরীর দ্বীপের কাছে নৌকা পৌঁছতেই বিপত্তি। অত্যাধিক যাত্রী বহনে ততক্ষণে সমুদ্রে নৌকা উল্টে গিয়েছে। অনেকেরই কপাল ভালো ছিল। কারণ নৌকা যেখানে উল্টেছিল সেখানে ছিল কোমর জল। তবে, এক মাসের আবদুলের কপালটা অন্যদের মতো ছিল না। জল থেকে যখন এক মাসের আবদুলকে হানিদা বের করে আনেন ততক্ষণে ছোট্ট শিশুটির শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
হানিদা প্রথমে বুঝতে পারেননি। ভেবেছিলেন নাকে-মুখে জল ঢুকে হয়তো দুধের শিশুর দম সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আবদুলকে বুকে করে যখন পারে এসে ওঠেন হানিদা, তখন বুঝতে পারেন তাঁর দুধের সন্তান আর নেই।
কোলে আবদুলের ঘুমন্ত দিদিকে নিয়েই সমানে নিথর আবদুলের দেহে হাত বুলিয়ে চলছিলেন হানিদা। তাঁর কান্না-ভেজা চোখে, ডুকরে ওঠা মাতৃত্বে তখন একটাই যেন আকুতি- আবদুল-আবদুল। নোনা জলের গ্রাসে আবদুলের শরীরটা ততক্ষণে ফটফটে ফর্সা হয়ে উঠেছে।
#StopKillingRohingya#myanmar#RohingyaCrisis
— Khurshid Hasan (@khurshid2hasan) September 15, 2017
#Rohingya #refugees
They fled for their lives. He didn't survive https://t.co/mPY4Ea8zVU pic.twitter.com/8IdkXgsY0Q
মাতৃত্বের হাহাকার একটা সময় বাঁধ ভাঙল। বন্যার জলের মতোই বাঁধভাঙা গতিতে নিথর আবদুলের দেহ হাতে তুলে নিয়েছিলেন হানিদা। সন্তানকে সাগরের বুকে বিসর্জন দেওয়ার আগে শেষবারের মতো মা-এর আদরে ভরিয়ে দিচ্ছিলেন আবদুলকে। কপাল থেকে চিবুক-চোখ-ঠোঁট কোথাও বাদ রাখছিলেন না হানিদা। তাঁর মাতৃত্বের হাহাকার যে ততক্ষণে ক্যামেরাবন্দি হয়ে গিয়েছে, তা হয়তো জানতেও পারেননি হানিদা। আর হানিদার মাতৃত্বের ডুকরে ওঠা দেখে সেখানে হাজির সকলের চোখে উপচে পড়েছিল জল।
আসলে হিংসা-যুদ্ধ-নিকেশ অভিযানের এমন পরিণতির ছবি বারবারই দেখে এসেছে মানব সভ্যতা। তবু যেন বিরাম নেই। কখনও সিরিয়া তো কখনও আলজেরিয়া, কখনও লিবিয়া। আবার কখনও আমাদের ঘরের পাশেই মায়ানমার। ছোট্ট আয়লান, আবদুলরা এভাবেই জীবনের খোঁজে বের হওয়া নৌকায় চিরতরে হারিয়ে যায় সমুদ্রের নীল গহন জলে।