ইরানে ঘটিত সন্ত্রাসে পাকিস্তানের হাত আছে বলে সমালোচিত ইমরান খান; এই কূটনীতি পাগলামি নয়
বেশ বিড়ম্বনায় পড়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
বেশ বিড়ম্বনায় পড়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। প্রাক্তন এই ক্রিকেটার সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ইরানে যান দু'দিনের সফরে এবং সেখানে ইরানি নেতৃত্বের সঙ্গে একটি যৌথ বিবৃতিতে স্বীকার করে নেন যে পাকিস্তানের মাটিকে ব্যবহার করা হয়েছে ইরানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালানোর জন্যে। একথা বলে ইমরান আশাপ্রকাশ করেন যে দুই দেশের সম্পর্ক এবার ইতিবাচক দিশায় এগোবে এবং পারস্পরিক বিশ্বাস আরও দৃঢ় হবে।
ইরানে ইমরানের এই বক্তব্য পেশের পরেই ঝড় ওঠে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে। বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রীকে একহাত নেন, দেশকে বিশ্বের সামনে ছোট করার অভিযোগ তোলেন। সরকার পক্ষে অবশ্য বলা হয়েছে যে ইমরানের বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
গত সোমবার, ২২ এপ্রিল, ইরানের রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানির সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ছেষট্টি বছরের ইমরান পাকিস্তানের মাটিকে সন্ত্রাসবাদীদের ব্যবহার করার কথা মেনে নেন এবং ভবিষ্যতে যাতে এরকম ঘটনা না ঘটে তার প্রতিশ্রুতিও দেন। এখানে উল্লেখ্য যে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গিহানায় ৪৪জন ভারতীয় আধা সেনা জওয়ান মারা যাওয়ার ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ ১৩ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তান সীমান্তের কাছে অনুরূপ জঙ্গি হানায় ইরানের ২৭জন সৈনিক প্রাণ হারায়। ভারতের মতো ইরানও সীমান্ত-সন্ত্রাস নিয়ে পাকিস্তানের উপরে ক্ষুব্ধ, যেমন ক্ষুব্ধ আফগানিস্তানও।
বিরোধীরা সরব, বললেন পাক প্রধানমন্ত্রী দেশকে খাটো করেছেন
পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) ইমরান সরকারকে সমালোচনা করে বলেন যে আজ পর্যন্ত কোনও পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে এরকম উক্তি করেননি এবং এর ফলে বিশ্বের সামনে ইসলামাবাদের মাথাই হেঁট হয়েছে। প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার তো বলেই দিয়েছেন যে এই মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানকে হাস্যস্পদ করেছেন। সম্প্রতি ইমরানের "নরেন্দ্র মোদী ফের প্রধানমন্ত্রী হলেই ভারত-পাক শান্তি প্রক্রিয়া এগোবে" মন্তব্যও নিয়েও অখুশি দেখায় বিরোধীদের। ইরান সফরকালীন ইমরানের "জার্মানি ও জাপান পাশাপাশি দেশ" মন্তব্যটি নিয়েও প্রচুর জলঘোলা হয়।
বিরোধীরা জানিয়েছে যে ইরানে ইমরানের মন্তব্য দেশের সুরক্ষাকে ব্যাহত করেছে এবং সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে "বিশ্বাসঘাতক" না বললেও বিরোধীরা আইনসভায় তাঁর জবাবদিহি চেয়েছে।
ইমরান খানের মন্তব্য বেহিসেবি নয়; ইরানের সঙ্গে মিত্রতা পাকিস্তানের প্রয়োজন
আপাতদৃষ্টিতে দেখলে ইমরানের মন্তব্যে বিরোধীদের রাগ হওয়ারই কথা। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খুব যে না জেনেশুনে এমন মন্তব্য করেছেন, তা বলা যাবে না। পশ্চিম এশিয়ার দুই বৈরী শক্তি সৌদি আরব ও ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ইতিহাসগতভাবে ভালো কিন্তু ইদানিং তেহরানের সঙ্গে সীমান্তবর্তী সন্ত্রাস নিয়ে ইসলামাবাদের সম্পর্ক বিশেষ ভালো নয়। দুই দেশের মাটিতেই উগ্রপন্থীরা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের মারণলীলা যার প্রভাব পড়েছে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক স্পম্পর্কে।
ইরান নিয়ে পাকিস্তানের দু'টি বড় দুশ্চিন্তা
ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি হওয়া পাকিস্তানকে দুইভাবে চিন্তিত করেছে।
প্রথম কারণ ভূ-কৌশলগত। প্রত্যেকটি প্রতিবেশীর সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক পাকিস্তানকে একঘরে করেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তার তিন প্রতিবেশী ভারত, ইরান এবং আফগানিস্তান নিজেদের অক্ষ শক্তিশালী করে পাকিস্তান ও চিনের মিত্রতার বিরুদ্ধে পাল্টা দিতেও পরিকল্পনা করেছে -- যেমন চাবাহার বন্দর প্রকল্প যাকে ইসলামাবাদ-বেইজিং-এর গ্বদর বন্দরের বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে। এদের মধ্যে ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক সহজে উন্নত হওয়া মুশকিল আর তাই পাকিস্তান এখন মরিয়া অন্তত ইরানের সঙ্গে যাতে সম্পর্ক ভালো করা যায়।
তাতে সৌদি আরব ও ইরান উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার ভারসাম্যটিও বজায় রাখা যাবে। পাশাপাশি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সুখের সম্পর্ক গত হওয়ার পরে পাকিস্তানের নতুন মিত্র চাই। চিন তো রয়েছেই, সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়া ওর ইরানের মতো আরও কিছু মার্কিন-বিরোধী দেশকে পাশে পেলে তা ইসলামাবাদকে নিঃসন্দেহে মনোবল যোগাবে।
দ্বিতীয়ত, ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার প্রভাব চিনের বহু-চর্চিত বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর উপরেও পড়তে পারে। সীমান্তবর্তী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই প্রকাণ্ড অর্থনৈতিক প্রকল্পটিকে সুরক্ষিত করার দায় অঞ্চলের সব দেশেরই যাতে এর সুফল ভোগ করতে পারে সবাই আর তাই নিজেদের মধ্যে সম্পর্ককে উন্নত করাটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ইমরান নিজেদের ভুল স্বীকার করেও সেই পথে পা বাড়াতে কার্পণ্য দেখাননি।
মনে রাখতে হবে যে ইমরানের সাম্প্রতিক ইরান সফরে পাকিস্তানের কোনও গোয়েন্দা আধিকারিক ছিলেন না যদিও বলা হচ্ছিল সফরের অন্যতম বড় ইস্যু হচ্ছে সীমান্ত সুরক্ষা। এর থেকে বোঝা যায় যে ইমরান সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নরমপন্থা অবলম্বন করে ইরানের সঙ্গে সমঝোতা করতে চেয়েছেন এই পর্বে।
ইমরান খানের মন্তব্য বেহিসেবি নয়; ইরানের সঙ্গে মিত্রতা পাকিস্তানের প্রয়োজন
সৌদি আরবের থেকেও সম্প্রতি পাকিস্তান বড় অর্থনৈতিক সহায়তা পায়; সৌদি রাজকুমার সে দেশে পদার্পণও করেন। অভিযোগ উঠছিল সৌদিদের দেওয়া সেই অর্থ আখেরে পাকিস্তানকে ইরান-বিরোধী শিবিরের দিকে ঠেলে দেবে। আদতে যে সেই সব অভিযোগ সত্যি নয়, সেটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন ইমরান বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা।
তবে বিরোধীদের কাছে ইমরানের এই কূটনৈতিক পদক্ষেপ অসম্মানজনক ঠেকেছে আর তিনি কীভাবে এখন ঘরের আক্রমণকে সামলান, সেটাই দেখার।