কলম্বাসের দেশে দুর্গাপুজো, নেই-নেই-এর মধ্যেও কিছু পাওয়া, প্রবাস জীবনে আঁকিবুকি কাটলেন শুভঙ্কর
আজও স্মৃতিটা তাঁকে নাড়া দেয়। ছোটবেলার কথা, বড়বেলার কথা ভাবতে ভাবতেই প্রবাস জীবনে পুজোটাকে কাটিয়ে দেন শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়। নিশ্চিত জীবনে পুজোর সময়ে অনেক নেই-নেই -এর জগৎ তাঁকে ঘিরে ফেলে।
শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়, নেসভিল, আমেরিকা----- দেড় দশক ধরে প্রবাস জীবনে পুজো মানেই এমন একটা স্মৃতি যা অন্য এক জগতে মনটাকে নিয়ে চলে যায়। খেয়াল পড়ে যায় অনেক কথা, অনেক স্মৃতিমাখা ভাললাগা মুহূর্ত। ফিরে আসে অনেক চেনা গন্ধ। মনের ভিতরেও যেন বহু ইন্দ্রিয় কাজ করতে থাকে তখন। তেমনই এক ইন্দ্রিয় বারবার যেন জানান দেয় শিউলি ফুলের গন্ধের কথা। বলে দেয় আশ্বিনের গাঢ় নীল আকাশের তলায় হাওয়ায় দোল খাওয়া কাশফুলের চঞ্চলতার কথা।
[আরও পড়ুন:মা সারদা এখানে দেবী দুর্গারূপে পূজিতা, তাই বিসর্জন নয় হয় 'ঘরবদল']
আমেরিকার যেখানে আমি থাকি সেই জায়গাটার নাম নেসভিল। কলম্বাসের দেশে দুর্গাপুজো অনেকই হয় এবং সেগুলির বয়সও কয়েক দশক ছাড়িয়ে গিয়েছে। আমার বাসভূমিতেও পুজো হয়। তবে, অফিসের ব্যস্ততায় এখানে পুজো হয় উইকএন্ডে। মূলত শুক্রবার থেকে রবিবার পর্যন্ত পুজো হয়। এই তিনদিন এখানে অফিস ছুটি থাকে।
এবারের পুজো প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। মণ্ডপ সজ্জার প্রস্তুতিও প্রায় শেষ পর্বে। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই সাউন্ড-বক্সে বেজে উঠবে গমগম স্বরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর ত্রোস্ত পাঠ। মণ্ডপে আসার পথে ইতি-উতি কিছু কাশফুল নজরে এসেছে। এখানে সন্ধের পর থেকেই বইছে হিমেল হাওয়া। শরীরটা ঠান্ডায় কেমন যেন শিরশির করে ওঠে। মনে পড়ে যায় কিছু পুরনো কথা। ফিরে আসে স্মৃতির ডালাটা। মনে হয় কেউ যেন স্মৃতিকোঠার আগলটা খুলে দিয়েছে।
কলকাতা-র পুজো মানেই বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা, বইয়ের স্টলে রাজনীতির চর্চায় প্রেম প্রেম ভাব। মন থেকে পুরোপুরি নাস্তিক। কিন্তু, পুজোর এই ক'টা দিন ওসব থেকে মুক্তি নিয়েই নিতাম। স্মৃতির পট যে কতটা টাটকা ও সতেজ হতে পারে তা এই দূর প্রবাসে বসে আজও টের পাই। পুজোর দিনগুলোতে প্রবাসের জীবনে ভোরবেলায় আমার ঘুমে যেন ভিড় করে স্বপ্নের দল। স্বপ্নে দেখতে সেই কিশোরী মেয়েটাকে। সলিল চৌধুরীর গানের সেই 'ময়না পাড়া'-র মেয়ের সঙ্গে তার যেন প্রবল মিল রয়েছে। তার মলিন রূপে সস্তার প্রসাধনীর সাজ। দুই বিনুনি করা চুল...তবু, তবু তার মুখে বসানো আছে প্রতিমার ছাচ। স্মৃতির দেওয়াল পেরিয়ে আমার ওকে ছুঁতে ইচ্ছে করে কখনও। ঘুম ভেঙে যায়। আর ওমনি হারিয়ে যায় সেই মেয়ে, ফুরিয়ে যায় আমার কৈশোর...আমি মনে মনে আমার প্রিয় শহর কলকাতার পুজো মণ্ডপের প্যান্ডেলে সেই মেয়েটিকে খুঁজে বেরাই...কোথায় পাব তারে...দূরে কোথায়, দূরে কোথায় বেজে ওঠে, মাথা দুলিয়ে নাচে কাশফুল, নীল আকাশে আপন মনে ভাসতে থাকে সাদা মেঘের ভেলা।
প্রবাসে সকলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান। তবে আমেরিকাতে দূষণের অভাবে প্রকৃতি এখনও অনেক নির্মল, পরিবেশ এখন অনেক পরিচ্ছন্ন, তাই...সকালে 'আশ্বিনের শারদপ্রাতে '-র অনুভূতি হয়। শরতের শারদ মেঘ ভাসে তীব্র সুনীল আসমানে, রাস্তার দু'ধারে অবহেলায় ফুটে থাকে কাশফুল, নীলকণ্ঠ পাখির মতো কিছু নাম না জানা পাখি নিঝুম সন্ধ্যায় কিচিরমিচির করতে করতে পথ হারিয়ে ফেলে।
আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে উত্তরবঙ্গে, মালদা শহরে। এখনও কিছু ছেলেবেলার বন্ধু-বান্ধবী রয়ে গিয়েছে ওখানে। পুজোর সময় আমরা বন্ধুরা দল বেঁধে হাজির হতাম রামকৃষ্ণ মিশনের পুজোতে। উদ্দেশ্য, বান্ধবীদের সাক্ষাৎ পাওয়া আর একটু খুনসুটি। ওরাও তখন সেখানে যেত। ওদের পরনে শাড়ি, শ্যাম্পু করা খোলা চুল, কপালে টিপ। ওখান থেকে বেরিয়ে মহানন্দা নদীর ধারের বাঁধ রোড ধরে আমরা আসতাম একটা পার্কে, আশ্চর্য, এই পার্কের নাম ছিল শুভঙ্কর উদ্যান। যেন হঠাৎ কত-শত প্রেমের গল্প এখনও স্মৃতি হয়ে লুকিয়ে আছে স্বপ্নের মধ্যে, যেমন 'রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে।'
আমেরিকার পুজো অনেক সাজানো গোছানো। সবটাই যেন বানানো গল্পের মতো। শরতের মতো প্রকৃতি আছে, মণ্ডপে পুজো-পুজো ভাব আছে, ধুনুচি নাচ, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, ঢাকের আওয়াজ... স...ব আছে। কিন্তু, কি যেন নেই-নেই ভাব। অফিসে পুজোর ছুটি নেই, স্কুল-কলেজে পুজোবকাশ নেই,পুজোয় বেড়াতে যাওয়া নেই, প্রথম দেখায় প্রথম প্রেমের সেই মেয়েটি নেই, বন্ধুদের সাথে প্রথম সিগারেট খাওয়া নেই। আমরা এই সব নিয়ে আর ভাবি না পুজোর ক'টা দিন...নিজেদের স্বান্তনা দেই... এই তো আছে, সব আছে, আড্ডা আছে, খিচুড়িভোগ আছে, গানবাজনা আছে, শারদীয়া সাহিত্য সংখ্যা আছে...আমাদের যেন সেই দশা... 'তোমার পূজার ছলে আমি তোমায় ভুলে থাকি।'
মহালয়টা আমার কাছে একটা উত্তরাধিকার...একটা ঊষাকালের পরম্পরা...দেশভাগের রাতে আমার উদ্বাস্তু ঠাকুরদা সাথে করে সদ্য কেনা একটা মর্ফি রেডিও নিয়ে এসেছিলেন...আমার অকাল প্রয়াত বাবা বলতেন, 'ওপারে আমাদের সব গিয়েছে...শুধু এই রেডিও-টা থেকে গিয়েছে...এটা কোন যন্ত্র নয়, এটা তোমাদের পিতৃ-পিতামহের চিহ্ন'....আমার মহালয়া সঙ্গে এই সব কিছু জড়িয়ে আছে। যেমন পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটা শূন্যতা। দশমীর সেই প্রণামের লগ্নে আমি আমার মা-বাবার পদচিহ্ন খুঁজে বেরাই...ওনারা এখন অন্য মহালয়ায়, সেটাই স্বর্গ সংসার তাঁদের...আমার হাতেই শুধু শূন্যতা, দশমীর বিসর্জন তাই নিরঞ্জন করে দেয় আমায়। আমি এই শূন্যতা ভুলতে পারি না...আমেরিকার বিত্ত-বৈভব বিলাস তো আর সবকিছু ভুলিয়ে দিতে পারে না।
পুজোতে আমার নাস্তিক স্ত্রী-ও নতুনভাবে সেজে ওঠে। আমিও সাজি, হয়ত মনে মনে। আমার সদ্য যুবতী কন্যা শাড়ি পরে। আমি অবাক হয়ে আমার ধুতির দিকে তাকিয়ে থাকি, আর ওর মধ্যে আমার মা-এর যৌবনবেলাকে দেখতে পাই। খুব ইচ্ছে করে আমার কবি কন্যাকে কলকাতার পুজো দেখাই। সে সেই পুজো দেখেছে দেড় দশক আগে, সেটাই শেষবার। আমাদের দেশে যাওয়া তো হয় গ্রীষ্মে, নয় তো শীতে। পুজোর সময় তো ছুটি নেই, বিশেষ করে স্কুল-কলেজে ছুটি নেই। কাজেই আমারা চাকুরেরা ছুটি নিতে পারলেও মেয়ে তো পারবে না। দেখা যাক, ও যখন চাকুরে হবে, তখন আমরা সবাই মিলে যাবো একবার কলকাতার পুজো দেখতে, অনেকদিনের পর। দেশের পুজো তো নিছক একটা প্রতিমা, প্যান্ডেল নয়। ওই পুজোও একটা উত্তরাধিকার....আশ্বিনের শারদপ্রাতে, কাশফুল, ভোরের শিউলি, নীলকণ্ঠ পাখি, ঢাকের শব্দ...নবীন-কিশোরী, তোমায় দিলাম পুজোর স্মৃতি, তোমার স্বপ্ন বয়ে যাক পুজোর পরম্পরা।
হপ্তান্তের প্রবাসের পুজোর তিন দিন প্যান্ডেলেই কেটে যায়। পুজো, ভিড়, আড্ডা, গানবাজনা, খানাপিনা। অন্যরকম লাগে সবকিছু। আসলে পুজো, প্রেম, প্রকৃতি, এই সব তো বুকের ভিতর ঘুমিয়ে থাকে, ঢেকে রাখে যেমন কুসুম, পাপড়ির আদলে ফসলের ঘুম'... আশ্বিনের শারদপ্রাতে সহসা ঘুম ভেঙে শুনি, আলোর বেণু বেজেছে কোথাও, তার মোহন সুরে মেতে উঠছে ভুবন।