চলে গেলেন 'হৃদয়ের রানি', যিনি ধর্মীয় গানকেও ধর্মনিরপেক্ষতার বন্ধনে বাঁধতে পেরেছিলেন
আর কখনও জেগে উঠবে না মিস আরেথা ফ্রাঙ্কলিনের কন্ঠ। যে কন্ঠ ৬০ দশকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সাধারণ মানুষের হৃদয়ে সেই ফ্রাঙ্কলিন আর নেই।
আর কখনও জেগে উঠবে না মিস আরেথা ফ্রাঙ্কলিনের কন্ঠ। যে কন্ঠ ৬০ দশকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সাধারণ মানুষের হৃদয়ে, সেই ফ্রাঙ্কলিন আর নেই। বৃহস্পতিবার ভারতীয় সময় রাতে আমেরিকার ডেট্রয়ট শহরে প্রয়াত হয়েছেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। দীর্ঘদিন ধরে অন্ত্রের ক্য়ানসারে ভুগছিলেন ফ্রাঙ্কলিন।
'গসপেল মিউজিক' মানে খ্রিষ্টান ধর্মালম্বীদের এক বিশেষ ধারার গানকেও যে ধর্মনিরপেক্ষতার বন্ধনে বাঁধা যায় তা দেখিয়ে দিয়েছেন আরেথা ফ্রাঙ্কলিন। তাঁর বিখ্য়াত হিটগুলির মধ্যে রয়েছে 'ডু রাইট ওম্যান- ডু রাইট ম্য়ান', 'থিঙ্ক', '(ইউ মেক মি ফিল লাইক) আ ন্য়াচারাল ওম্য়ান' অ্য়ান্ড 'চেন অফ ফুলস'। এই সমস্ত গানগুলিই যেমন এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আধুনিক মহিলার মনষ্ককে তুলে ধরেছে তেমনি গানগুলির মধ্য়ে ফুঁটে বেরিয়েছে কামনার উদ্রেক থেকে দৃঢ় মানসিকতা ও দীর্ঘ-যন্ত্রণার আবেগ। কিন্তু এসবরেই মধ্যে সবকিছুকে ছাপিয়ে আরেথা ফ্রাঙ্কলিনের কন্ঠে যে-টা বড় হয়ে ওঠে সেটা হল এক অদম্যতা, ভালবাসার ইচ্ছা যাকে অবার 'টেকেন ফর গ্র্যান্টেড' বলা যায় না।
'রেসপেক্ট' নামক গানটা যেন ফ্রাঙ্কলিনের একটা সিগনেচার টিউন-ই হয়ে গিয়েছে। এই গানটি ছিল একজন কর্মরত মহিলা বাড়িতে ফিরে কীভাবে স্বামীর প্রশংসায় প্রশংসিত হতে চায়- তা নিয়ে। এই গানটির মধ্যে দিয়ে যেন এক মহিলার মধ্যে দিয়ে সমস্ত নারী সমাজের স্বাধীন চিন্তা, পুরুষের সমান অধিকার পাওয়া এবং নারীবাদী সত্ত্বার কথাই ঝড়ে পড়ে।
এক অসামান্য কেরিয়ারের অধিকারী ফ্রাঙ্কলিনের ১০০-রও বেশি একক গান বিলবোর্ডের চার্টে স্থান করে নিয়েছিল। যারমধ্যে রয়েছে ১৭টি 'টপ টেন পপ সিঙ্গলস' এবং ২০টি 'নম্বর ওয়ান আর অ্যান্ড বি হিটস'। তিনি ১৮টি কম্পিটিটিভ গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডস-ও জিতেছিলেন। এরমধ্যে ১৯৯৪ সালের লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড-ও রয়েছে। তিনি প্রথম মহিলা যিনি ১৯৮৭ সালে 'রক অ্যান্ড রোল হল অফ ফ্রেম'-এ স্থান পেয়েছিলেন। এটা ছিল 'রক অ্যান্ড রোল হল অফ ফ্রেম'-এর দ্বিতীয় বর্ষ।
২০০৯ সালে বারাক ওবামা যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন তখন আরেথা ফ্রাঙ্কলিন সেখানে তাঁর গলার মাধুর্যে সকলকে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে জিমি কার্টার এবং ১৯৯৩ সালে বিল ক্লিনটনের প্রি-ইনাগুরেশন কনসার্টেও গান গাওয়ার কৃতিত্ব রয়েছে ফ্রাঙ্কলিনের ঝুলিতে। তাঁর কন্ঠ সকলের হৃদয়ে এতটাই ছুঁয়ে যেত যে ফ্রাঙ্কলিন ছাড়া সঙ্গীতের কথা যেন ভাবাই যেত না। ১৯৬৮ সালে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ারের অন্তিমযাত্রাতেও তাই ফ্রাঙ্কলিনের গান সমানভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল।
ফ্রাঙ্কলিন 'গসপেল মিউজিক'-এর মাধ্যমে এমন একটি ধারা তৈরি করেছিলেন যাতে 'আর অ্যান্ড বি সিঙ্গারস' বলে একটি জেনারেশন-এর জন্ম হয়েছিল। যার সার্থক উত্তরসূরীদের মধ্যে রয়েছেন নাটালিয়ে কোলে, হুইটনি হুইসটন, মারিয়া ক্যারে, আলিসিয়া কেসরা। ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গীত সত্ত্বা এতটাই প্রেরণা এবং অন্যন্য ছিল যে খোদ 'রোলিং স্টোন' তাদের ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে স্থান দিয়েছিল। 'রোলিং স্টোন'-এর ২০১০-এর '১০০ গ্রেটেস্ট সিঙ্গারস অফ অল টাইম'-এর তালিকাতেও স্থান করে নিয়েছিলেন আরেথা ফ্রাঙ্কলিন।
আরেথা ফ্রাঙ্কলিন যখন কন্ঠ ছেড়ে গান ধরতেন তখন যেন মনে হত সত্যি সত্যি স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনও স্বর যেন আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রকৃত অর্থে তিনি যেন ছিলেন ভগবানের এক দান। তাই তিনি 'কুইন অফ সোল' মানে 'হৃদয়ের রানি'। ফ্রাঙ্কলিন সার্থকভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন কেন মহিলাদের কাছে সঙ্গীত অত্যন্ত একটা প্রিয় মাধ্যম।
একটা সময় পপ, সোল এবং আর অ্যান্ডি বি-র মতো ধারার মধ্যে বেশি করে ঘোরাফেরা করলেও ফ্রাঙ্কলিনের কন্ঠের মূল আধার ছিল গসপেল মিউজিক। তাই ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হওয়া 'অ্যামেজিং গ্রেস', 'ওয়ান লর্ড, ওয়ান ফেইথ, ওয়ান ব্যাপ্টিসম' একটা রেকর্ড সংখ্যক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এমনকী এই অ্যালবামের গানগুলিকে ১৯৮৭ সালে নিউ বেথাল চার্চ নতুন করে রেকর্ডও করিয়েছিল। বলতে গেলে ফ্রাঙ্কলিনের কন্ঠের মাদকতা যেমন আম জনতার মানসে চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছে ঠিক তেমনি গির্জার ধর্মীয় গানের ধারাতেও এক দেবীর তকমা যেন পেয়ে গিয়েছেন তিনি। কন্ঠের এমন এক আত্মাকে কুর্ণিশ না জানিয়ে কী ভাবেই এই কাহিনি এখানে শেষ করা যায়!