ভারতে এক বিচারকের 'রহস্যজনক' মৃত্যুর তদন্ত দাবি
ভারতে বিজেপির বর্তমান সভাপতি অমিত শাহ অভিযুক্ত ছিলেন, এমন এক মামলার শুনানী করার সময়ই মারা যান সিবিআই বিচারক ব্রিজগোপাল লোয়া। তিন বছর পর বলা হচ্ছে ওই মৃত্যু ছিল রহস্যজনক, দাবি উঠেছে তদন্তের।
ভারতে সিবিআই বিশেষ আদালতের একজন বিচারক ব্রিজগোপাল লোয়ার মৃত্যুর তিন বছর পর তার সেই মৃত্যুকে ঘিরে নানা অস্বস্তিকর প্রশ্ন ওঠায় সেই ঘটনায় তদন্তের দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।
মৃত্যুর ঠিক আগে বিচারক লোয়া গুজরাটের বহুল-আলোচিত সোহরাবউদ্দিন শেখ এনকাউন্টার মামলাটি শুনছিলেন, যাতে অন্য আরও অনেকের সাথে বিজেপির বর্তমান সভাপতি অমিত শাহ-ও অভিযুক্ত ছিলেন।
সম্প্রতি ভারতের একটি পত্রিকা বিচারক লোয়ার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তার ভিত্তিতে দাবি করেছে তার মৃত্যু হয়েছিল অত্যন্ত রহস্যজনক পরিস্থিতিতে - তারপর থেকেই দেশের প্রথম সারির বহু বিরোধী নেতা সেই মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত দাবি করেছেন।
হাইকোর্টের একাধিক সাবেক বিচারপতি এবং ভারতের নৌবাহিনীর এক সাবেক প্রধানও এখন প্রকাশ্যেই দাবি করেছেন, বিচারক লোয়ার মৃত্যু রহস্যের কিনারা হওয়া দরকার।
এই বিতর্কের শুরু গত ২০ নভম্বের ভারতের 'দ্য ক্যারাভান' নামে একটি জার্নালে বিচারক লোয়ার মৃত্যু নিয়ে পরপর বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর।
মুম্বাইতে সিবিআই বিশেষ আদালতের বিচারপতি ব্রিজগোপাল হরকিষেণ লোয়া নাগপুরে এক সফরে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর রাত থেকে ১লা ডিসেম্বর ভোররাতের মধ্যে কোনও এক সময়ে - এবং সে সময় সংবাদমাধ্যম লিখেছিল হৃদরোগেই তার মৃত্যু হয়।
আজ তিন বছর বাদে তার পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে ক্যারাভান পত্রিকাটি দাবি করেছে, সেই মৃত্যু মোটেই স্বাভাবিক ছিল না - বরং রীতিমতো রহস্যজনক পরিস্থিতিতে বিচারক লোয়ার জীবন শেষ হয়ে গিয়েছিল।
তার ওপর নানা মহল থেকে প্রচন্ড চাপ ছিল এবং কেউ কেউ তাকে বিরাট অঙ্কের ঘুষের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন - এতদিনের নীরবতা ভেঙে বিচারক লোয়ার পরিবারের কেউ কেউ ক্যারাভানকে এমন কথাও জানিয়েছেন।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই আস্তে আস্তে প্রথমে ভারতের সোশ্যাল মিডিয়ায় ও পরে রাজনৈতিক মহলেও ঝড় উঠতে শুরু করে।
এখন ভারতে সুপরিচিত ব্যক্তিত্বদের অনেকেই একে একে এই বিতর্কে মুখ খুলছেন এবং বিচারক লোয়ার মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত দাবি করছেন। সেই তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে।
গত ২৩ নভেম্বর এই বিষয়ে প্রথম একটি প্রেস বিবৃতি দেয় ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিএম।
তাদের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি সেই সঙ্গেই টুইট করেন, বিচারক লোয়ার মৃত্যুকে ঘিরে খুন, ঘুষ, আইনকে পাশ কাটানো ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব বিস্তারের যে সব প্রশ্ন উঠছে তা অত্যন্ত বিচলিত হওয়ার মতো - এবং এর অবিরম্বে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
পরদিন একই ধরনের টুইট করেন সিনিয়র কংগ্রেস নেতা কপিল সিবাল ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী তথা আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
দেশের সাবেক আইনমন্ত্রী কপিল সিবাল লেখেন এটা একটা 'চিলিং রিভিলেশন' - হাড় হিম করা তথ্য, এবং বিচারপতিদের নিজেদের স্বার্থেই এ নিয়ে মুখ খোলা প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
কেজরিওয়াল লেখেন, মূল ধারার মিডিয়াগুলোর সাহস করে এগিয়ে আসা উচিত ও বিষয়টি নিয়ে বিরাট করে খবর করা উচিত।
তিনি এখানেই থামেননি, আরও বলেছেন "আমরা আগে ভাবতাম বিচারবিভাগকে কেনা যায়। এখন দেখছি, তারও তো দরকার নেই - বিচারবিভাগকে যে কীভাবে ভয় দেখানো যায় সেটা তো দেখাই যাচ্ছে।"
ইতিমধ্যে দিল্লি হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপিত জাস্টিস এ পি শাহ-ও বিচারক লোয়ার মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত দাবি করেন।
এদিকে এখন জানা যাচ্ছে, মুম্বই হাইকোর্টের আর একজন সাবেক বিচারপতি বি এইচ মার্লাপাল্লে গত ২১ তারিখেই প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লিখে এই ঘটনায় বিশেষ তদন্তকারী দল গঠনের অনুরোধ জানিয়েছেন।
ভারতের নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান এল রামদাসও চিঠি লিখেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রকে, দাবি করেছেন বিচারবিভাগীয় তদন্ত।
এমন কী বিজেপির বিদ্রোহী এমপি শত্রুঘ্ন সিনহাও এদিন মন্তব্য করেছেন এই ঘটনা 'সমাজের জন্য একটা কলঙ্ক' - পার্লামেন্টের ভেতরে ও বাইরে এর তদন্ত হওয়া উচিত।
বিজেপির আর এক সাবেক ক্যাবিনেট মন্ত্রী অরুণ শৌরিও এই ঘটনায় সংবাদমাধ্যমের নীরবতার কড়া সমালোচনা করেছেন।
সিবিআই জজ লোয়া বিচারবিভাগীয় কাঠামোতে খুব উঁচু পর্যায়ে ছিলেন না ঠিকই - কিন্তু মৃত্যুর আগে তার এজলাসেই শুনানি চলছিল সোহরাবউদ্দিন শেখ এনকাউন্টার মামলার, যাতে গুজরাটের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ছিলেন অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত।
বিচারক লোয়ার মৃত্যুর পরের মাসেই সিবিআই আদালত অমিত শাহকে ওই মামলায় বেকসুর খালাস করে দেয়, তিনি তখন বিজেপির অত্যন্ত প্রভাবশালী সর্বভারতীয় সভাপতি - মাসকয়েক আগেই যে দল বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে দেশের ক্ষমতায় এসেছে।
প্রসঙ্গত, অমিত শাহ বা তার দলের পক্ষ থেকে বিচারক লোয়ার মৃত্যু-সংক্রান্ত বিতর্ক নিয়ে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও মন্তব্য করা হয়নি।
তবে এই ঘটনায় তদন্তের দাবি যেভাবে জোরালো হচ্ছে তাতে আজ না-হোক কাল বিজেপিকে মুখ খুলতেই হবে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা।