শেষ ভাষণে যা বললেন বিদায়ী রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা
রাষ্ট্রপতি হিসাবে বিদায় নেওয়ার আগে ডেমোক্র্যাট তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ভাষণে সকলকে মুগ্ধ করলেন।
শিকাগো, ১১ জানুয়ারি : রাষ্ট্রপতি হিসাবে বিদায় নেওয়ার আগে ডেমোক্র্যাট তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ভাষণে সকলকে মুগ্ধ করলেন। আট বছর আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রথমবার জিতে তিনি বিজয়ী ভাষণ দেন শিকাগোতে। আর বিদায় বেলাতেও সেই শিকাগোতেই শেষ ভাষণ দিলেন বারাক ওবামা।
পরবর্তী ডেমোক্র্যাটদের জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়ার সময় এসেছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প একেবারে অভূতপূর্বভাবে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। অনেকেই তাঁকে অপছন্দ করছেন। তবে ওবামা কিন্তু হোয়াইট হাউস ছাড়ছেন একেবারে মাথা উঁচু করেই।
বিদায়ী ভাষণে ওবামা যা বললেন :
আমার আমেরিকাবাসী, মিশেল ও আমি আপনাদের শুভাকাঙ্খা দেখে আনন্দিত। আজ আমার পালা আপনাদের ধন্যবাদ জানানোর। হয়ত আমরা সামনাসামনি কথা বলিনি, সহমত পোষণ করিনি তবে আপনারা আমাকে সৎ থাকতে সাহায্য করেছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন ও পথ চলতে সাহায্য করেছেন। প্রতিদিন আমি আপনাদের থেকে শিখেছি। আমাকে ভালো রাষ্ট্রপতি বানিয়েছেন আপনারাই, সঙ্গে ভালো মানুষও।
৮ বছর রাষ্ট্রপতি ছিলাম আমি। আমার বিশ্বাস, আমরা সকলেই সমান। জীবন, স্বাধীনতা ও আনন্দে থাকার অধিকার সকলের সমান। আমাদের এভাবে থাকাই আরও সুন্দর ঐক্য গড়ে তুলবে।
২৪০ বছর ধরে আমাদের দেশ নাগরিকদের কাজ করার ও নানাভাবে জীবনকে অতিবাহিত করার সুযোগ করে দিয়েছে। অভিবাসীরা দলে দলে এসেছেন, উদ্বাস্তুরা এসেছেন। সকলকেই জায়গা করে দিয়েছে আমাদের দেশ। অর্থাৎ আমাদের দেশ আমেরিকা অনন্য। আমরা শুরু থেকেই অসাধারণ ছিলাম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমরা সময়ে সময়ে নিজেদের বদলেছি।
অবশ্যই আমাদের উন্নতিতে চড়াই-উতরাই ছিল। গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে গেলে রাস্তা কঠিন হবে, রক্ত ঝরবে। দু'পা এগোতে গেলে এক পা পিছিয়ে আসতে হবে। তবে আমেরিকা থেমে থাকেনি। এগিয়ে গিয়েছে।
কুড়ির ঘরে যখন আমার বয়স তখন প্রথমবার আমি শিকাগো এসেছিলাম। এখানেই একটি স্টিলের মিলে কর্মজীবন শুরু করি। এখানকার জীবন আমায় শিখিয়েছে কীভাবেও সংগ্রাম ও হারানোর যন্ত্রণার মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়। এখানেই আমি শিখেছি, বদল তখনই সম্ভব যখন সাধারণ মানুষ তাতে যুক্ত হবে, একজোট হয়ে কোনও কিছু দাবি করবে।
যদি আট বছর আগে আমি আপনাদের বলতাম, আমেরিকা মুদ্রাস্ফীতি থেকে বেরিয়ে আসবে, গাড়ি শিল্পে নতুন করে জোয়ার আসবে, আমার সময়ে আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হবে, কিউবার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন হবে। অথবা ইরানের পরমাণু প্রকল্প আমরা বন্ধ করব বা ৯/১১ হামলার অপরাধীকে সাজা দেব, তাহলে আপনারা ভাবতেন আমি বাড়িয়ে বলছি, তবে ঘটনা হল, এগুলি সবই সম্ভব হয়েছে।
আমরা ২ কোটি সহ নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য বীমা করা সম্ভব হয়েছে। এবং সমলিঙ্গ বিবাহ নিয়েও আমরা লড়াইয়ে নেমে জয়লাভ করেছি। তবে এসবই আমরা যেমন করেছি, তেমনই আপনারাও সঙ্গে ছিলেন। আপনাদের জন্যই আমেরিকা অসাধারণ সুন্দর ও শক্তিশালী জায়গা হয়ে উঠেছে।
আগামী দশদিনের মধ্যে গণতন্ত্রের এক আদর্শ উদাহরণ প্রত্যক্ষ করবে দুনিয়া। নির্বাচনে জয়লাভ করা একজনের হাত থেকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে আর এক বিজয়ী প্রার্থীর হাতে। আমি নিজে এব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কথা দিয়েছি যে আমার প্রশাসন শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, ঠিক যেভাবে জর্জ বুশ জুনিয়র আমাকে ক্ষমতা হাতবদল করেছিলেন।
আমরা বিশ্বর সবচেয়ে বিত্তবান, সবচেয়ে শক্তিশালী ও সবচেয়ে শ্রদ্ধা অর্জন করা দেশ। আমাদের যৌবন, বৈচিত্র ও প্রাণখোলা মনোভাব ও ঝুঁকি নিয়ে সাফল্য পাওয়ার ক্ষমতা এটা ইঙ্গিত করছে যে আগামী দিনও আমাদেরই হতে চলেছে। তবে এই সমস্তকিছু তখনই সম্ভব হবে যখন আমাদের গণতন্ত্র মজবুত থাকবে, আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব।
গণতন্ত্র তখনই সুন্দর হবে যখন সকলে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পাবেন। বর্তমানে অর্থনীতি ফের একবার ছুটতে শুরু করেছে। শ্রমুকের মজুরি, রোজগার বাড়ছে। অবসরের পরে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। দারিদ্রতা কমেছে, বেকারত্বের হার গত দশবছরে সর্বনিম্ন হয়েছে।
আইনকে বৈষম্যের ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। আমাদের সংবিধান সেকথাই বলে। তবে শুধু আইন দিয়ে চলবে না। মানুষের মননকে বদলাতে হবে। কারণ মানুষকে আপনি তখনই বুঝতে পারবেন যখন তাঁর জায়গায় দাঁড়িয়ে আপনি পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করবেন।
আবহাওয়ার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমরা ৮ বছরে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছি। বিদেশ থেকে আমদানি করা তেলের উপরে নির্ভরশীলতা অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছি। পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উপরে নির্ভর হয়েছি যাতে পৃথিবীকে বাঁচানো সম্ভব হয়।
আমাদের পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে নাগরিকদের অসীম সাহস ও আইন রক্ষাকারীদের তৎপরতায় কোনও বিদেশি জঙ্গি শক্তি গত ৮ বছরে আমাদের দেশে হামলা করতে পারেনি। তবে বস্টন ও অরল্যান্ডোর ঘটনা আমাদের দেখিয়েছে, ধর্মীয় উগ্রতা কতটা ভয়ানক হতে পারে। আমাদের আইন রক্ষাকারীরা এখন আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী। ওসামা বিন লাদেন থেকে শুরু করে হাজারো জঙ্গিকে আমরা ধরেছি।
আইএসআইএসের বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু হয়েছে তাতে আমরা অগ্রণী ভূমিকা গ্রণ করেছি। আইএসকে ধ্বংস করা যাবে এবং যারা আমেরিকাকে হুমকি দিচ্ছে তারা পার পাবে না। যারা আমেরিকার সেবা করেছেন, সকলের প্রধান হিসাবে কাজ করা আমার কাছে অত্যন্ত সম্মানের।
আমার আমেরিকাবাসী, আপনাদের হয়ে কাজ করতে পেরে আমি সম্মানিত। আমি এখানেই থামছি না। আমি সহনাগরিক হিসাবে সবসময় আপনাদের পাশে থাকব। আমি চাই বদল আনতে আপনারা নিজেদের উপরেই সবচেয়ে বেশি ভরসা রাখুন। আমরা পারবই।