নতুন মডেলের গাড়ি চুরি করা যায় মাত্র ১০ সেকেন্ডে
যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয় 'হোয়াট কার?' ম্যাগাজিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে বর্তমানে বাজারে আসা সর্বাধুনিক কীলেস এন্ট্রি সিস্টেমযুক্ত গাড়ির মডেলগুলো সহজেই হাইজ্যাক করা যায়।
নতুন এবং সর্বাধিক জনপ্রিয় কয়েকটি গাড়ি যেকোনো মুহূর্তে চুরি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর কারণ কী-লেস এন্ট্রি সিস্টেম বা চাবি-বিহীন প্রবেশ প্রযুক্তির দুর্বলতা।
এই পদ্ধতির কারণে চালকরা তাদের পকেট থেকে চাবি বের না করেই গাড়িগুলো খুলতে এবং চালু করতে পারে।
যুক্তরাজ্যের 'হোয়াট কার?' ম্যাগাজিন সাতটি গাড়ির মডেল পরীক্ষা করে। যার প্রতিটি চাবি-বিহীন এন্ট্রি এবং স্টার্ট সিস্টেমযুক্ত।
একটি ডিএস থ্রি ক্রসব্যাক এবং অওডি টিটি আরএস এর মতো গাড়ি চুরি গেছে মাত্র ১০ সেকেন্ডের মাথায়। এবং মাত্র ৩০ সেকেন্ডে চুরি গেছে ল্যান্ড রোভার ডিসকভারি স্পোর্ট টিডি ফোর ওয়ান এইটি এইচএসই মডেলের গাড়িটি।
গাড়ি চুরির ক্ষেত্রে চোরেরা যে ধরণের পদ্ধতি ব্যবহার করে, হোয়াট কারের সুরক্ষা বিশেষজ্ঞরা সেইসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষাগুলো করেন।
তারা গাড়িতে উঠতে এবং গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে যে সময় খরচ হয়েছে তা পরিমাপ করেন।
ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে গাড়ি চুরির হার আট বছরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
গত বছর এক লাখ ৬০ হাজার গাড়ির চুরির খবর পাওয়া যায়।
এবং চলতি বছরের শুরুতে ব্রিটেনে গাড়ি চুরির জন্য যে পরিমাণ বীমা দাবি করা হয়েছে সেটা গত সাত বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
হঠাৎ গাড়ি চুরি বেড়ে যাওয়ার পেছনে, নতুন গাড়িগুলোর চাবি-বিহীন প্রযুক্তিকে আংশিকভাবে দায়ী করেছে বীমা সংস্থাগুলো।
তবে চুরি যাওয়া গাড়ির মধ্যে কতো শতাংশ চাবি-বিহীন প্রযুক্তির,তার কোন সঠিক হিসাব নেই।
আওডির মূল সংস্থা, ভক্সওয়াগান গ্রুপ বলেছে যে তারা তাদের গাড়ির সুরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে নিয়মিত কাজের অংশ হিসাবে পুলিশ এবং বিমাকারীদের সাথে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করছে।
ডিএস-এর মূল সংস্থা - পিএসএ গ্রুপ, হোয়াট কারকে জানিয়েছে যে, গাড়ির নিরাপত্তার সম্ভাব্য দুর্বলতাগুলো সমাধানের জন্য তাদের একটি নিবেদিত দল ছিল যারা গাড়ি চুরির পদ্ধতিগুলি বিশ্লেষণ করতে পুলিশের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করতো।
তারা আরও বলেছে যে ডিলাররা মালিকের অনুরোধে গাড়ীর চাবি-বিহীন এন্ট্রি সিস্টেমগুলো নিষ্ক্রিয় করতে পারে।
জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার বলেছেন, "পরীক্ষিত ডিসকভারি স্পোর্ট মডেলটি এখন আর উৎপাদনে নেই। তবে বর্তমানে ডিসকভারি স্পোর্ট মডেলটি তৈরি করা হচ্ছে সেটায় এমন সব প্রযুক্তি রয়েছে যা সংগঠিত আক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম।
"এছাড়াও, আমাদের সমস্ত যানবাহনে রয়েছে ইন-কন্ট্রোল ট্র্যাকিং ডিভাইস। এ কারণে গাড়িটি চুরি গেলেও ৮০% সফলতার সাথে তা আবার পুনরুদ্ধার করা যাবে।"
আরও পড়তে পারেন:
কত ধরণের যানবাহন চলে ঢাকার রাস্তায়
ঈদের মৌসুমে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে কেন?
একটি গাড়ি চুরির ঘটনা আপনার ছুটির দিনটাকে বরবাদ করে দিতে পারে
যুক্তরাজ্যের সাউথ ওয়েলসের নিউপোর্ট এলাকার বাসিন্দা স্টিফেন সাভিগার (৫৯) তার স্ত্রী এবং দুই বন্ধুকে নিয়ে হিথরো বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছিলেন। সেদিনই তার চাবি-বিহীন গাড়িটি হামলার শিকার হয়।
এই দুই দম্পতি তাঁদের এক বন্ধুর ৬০তম জন্মদিন উদযাপনের উদ্দেশ্যে ক্রুজ ভ্রমণ করতে সিঙ্গাপুরে যাচ্ছিলেন।
তারা যখন রিডিং সার্ভিসে টয়লেট বিরতির জন্য থামেন তখনই চোররা সুযোগ বুঝে গাড়িটিতে হামলা চালায়।
মিঃ সাভিগারের ফোর্ড মন্ডেও মডেলের গাড়ি চুরি করা হয়নি, কিন্তু সেই গাড়ি থেকে যা নেওয়া হয়েছিল তা তাদের ছুটির আনন্দই মাটি করে দেয়।
"যখন আমরা ভিতরে ছিলাম তখন চোররা আমার গাড়ির লক সিস্টেমটি জ্যাম করে দেয়," তিনি বলেন। "তারা আমার ট্র্যাভেল ব্যাগটি, মানে যেটার ভেতরে আমার এবং আমার স্ত্রীর পাসপোর্ট চশমা এবং একটি আইপ্যাড ছিল সেটা চুরি করে নিয়ে যায়।
পরে এই দম্পতি গাড়ি চালিয়ে বাড়িতে ফেরেন এবং, পাসপোর্ট অফিসে যান, পরের দিন হিথরোতে আর আসেন এবং অন্য একটি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের টিকেট কাটেন।
তারা ক্রুজটি ধরতে ঠিক সময়ে ধরতে সিঙ্গাপুরে পৌঁছাতে পেরেছিলেন ঠিকই। কিন্তু একটি ঘটনার জন্য তাদের পুরো একদিন ভোগান্তি পোহাতে হয়।
পাঁচ মাস পরে মিঃ সাভিগার বলেছিলেন যে এখনও তার ওই ঘটনা নিয়ে কথা বলতে খারাপ লাগে। "এটি ছিল এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। আমরা দু'বছর ধরে এই ভ্রমণের পরিকল্পনা করছিলাম। আমাদের সাথে যা হয়েছে তা একটি ভয়াবহ অপরাধ।"
'মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে'
উত্তর লন্ডন থেকে আসা অ্যান্ড্রুর চাবি-বিহীন মার্সিডিজ সি টু টুয়েন্টি মডেলের গাড়িটি গত বছরের নভেম্বরে তার বাড়ির বাইরে থেকে চুরি যায়।
তিনি বিবিসিকে বলেন, "আমার গাড়ীটিতে চাবি-বিহীন প্রবেশ প্রযুক্তি ছিল এবং আমার চাবি সামনের দরজার কাছেও ছিল না।"
গাড়িটি এখনও নিখোঁজ রয়েছে এবং অ্যান্ড্রু বলেছেন তার মার্সিডিজ কীভাবে চুরি হয়েছে তার কোন ব্যাখ্যা তার কাছে নেই।
তিনি বলেন: "আমাকে মার্সিডিজ থেকে বলা হয়েছিল যে আমি যদি গাড়ীটি লক করার সময় চাবিতে দুবার চাপ দেই তাহলে এটি নিরাপদে থাকবে। কারণ এই চাবিটি ট্রান্সমিট করা যায়না। আমার জন্য একটা নিয়মিত অনুশীলনের মতো ছিল। গাড়ির চাবিটি ছিল আমার বাড়ির চারতলায় পেছনের দিকে।"
"আমি বিশ্বাস করি নির্মাতারা যানবাহনকে আরও সুরক্ষিত দাবি করে লোকজনকে বিভ্রান্ত করছে। আমার বীমা অনুসারে শুধুমাত্র লন্ডনে আমার পোস্টকোডের আওতায় চাবি-বিহীন এন্ট্রিসহ ১০ টিরও বেশি গাড়ি চুরি হয়েছে।"
চাবি-বিহীন গাড়ি চুরি কিভাবে হয়
গাড়ি চোরেরা, সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় কাজ করে।
তারা প্রথমে বাড়ির বাইরে দাঁড় করানো একটি গাড়িকে লক্ষ্যবস্তু বানায়।
একজন অপরাধী গাড়ীর কাছে এমন একটি ডিভাইস ধরে রাখে যা চাবির সিগন্যালকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
এসময় অপর চোর অন্য একটি ডিভাইস নিয়ে ঘরের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে যা সেই সিগন্যালকে ঘরের ভেতরে থাকা চাবির সঙ্গে সংযুক্ত করে। এভাবে পুরো লক সিস্টেমটিকে বোকা বানানো হয়।
গাড়িগুলো একবার চুরি হয়ে গেলে সেগুলো সাধারণ ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয় বলে জানায় পুলিশ।
গাড়ি নির্মাতারা চাবি-বিহীন গাড়ির এ ধরণের চুরি রোধ করতে নতুন প্রযুক্তি চালু করার কথা জানিয়েছে। যার নাম মোশন সনাক্তকরণ প্রযুক্তি।
হোয়াট কার জানায় এই সুরক্ষা ব্যবস্থা ইন্সটল থাকার কারণে গাড়ির ভেতরে অবৈধভাবে প্রবেশ করা যায়না।
যদিও প্রযুক্তিটি বাজারে এখনও প্রচলিত হয়নি।