যুক্তরাজ্য-ভারত সপ্তাহে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন বিশিষ্টরা
আজকের ক্রমবিভক্ত এবং সংকীর্ণ বিশ্বে ভারত-ব্রিটেন দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্বের প্রয়োজন বলে মনে করছেন দুইদেশের কূটনীতিক ও উদ্যোগপতিরাই।
ভারত ও ব্রিটেনের সম্পর্কটা অত্যন্ত পুরনো। কিন্তু এই মুহুর্তে দুদেশই চাইছে সেই সম্পর্কের নস্টালজিয়াকে ঝেড়ে ফেলে নতুন করে আধুনিক পৃথিবীর উপযোগী এক সম্পর্ক গড়ে তুলতে। কারণ এতে দুদেশেরই লাভ আছে।
লন্ডন অথবা নয়াদিল্লির সম্পর্ক ওপর ওপর 'উষ্ণ ও ঘনিষ্ঠ' মনে হলেও একটু গভীরে গেলেই দেখা যাবে সমস্যা রয়েছে। এমনিতে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুই দেশের অবস্থান ঘনিষ্ঠ হলেও দেখা যায় মিত্রদেশ হিসেবে দুদেশের কেউই পরস্পরকে প্রথম পছন্দ হিসেবে মনে করে না। এই জন্য দুই দেশের মধ্যের ইতিহাস দায়ী। ইতিহাসের বোঝা কেউই এখনও ঝেড়ে ফেলতে পারেনি।
আজকের ক্রমবিভক্ত এবং সংকীর্ণ বিশ্বে ভারত-ব্রিটেন দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্বের প্রয়োজন বলে মনে করছেন দুইদেশের কূটনীতিক ও উদ্যোগপতিরাই। তাঁরা বলছেন, আজকের বিশ্বায়ন, মুক্ত বাণিজ্য, সহযোগিতার মূল্য হারান পৃথিবীকে এই মিত্রতা দিশা দিতে পারে। তবে এই পথটি দীর্ঘ এবং কঠিন তা বলাই বাহুল্য। কারণ দুর্ভাগ্যবশত, ইন্ডো-ব্রিটিশ সম্পর্ক, এখনও বড় 'লেনদেন সম্পর্কিত'। লন্ডন চায় ব্রিটিশ পণ্যের জন্য আরও বেশই ভারতীয় বাজার। আর নয়া দিল্লি আগ্রহ ভারতীয় শিক্ষার্থীদের এবং পেশাদারদের জন্য ব্রিটেনে প্রবেশ এবং কাজের নিয়মকানুন শিথিল করুক ব্রিটেন। কিন্তু দুইদেশেই এখনও দ্বিপাক্ষিক এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
ছোট পদক্ষেপে এই পথে এগোতে শুরু করেছে দুই দেশ। ব্রিটিশ উপনিবেশের ৫৩ টি দেশকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল কমনওয়েলথ। বর্তমানে এই সংগঠনকে মৃতই বলা যায়। এই সংগঠনটিকেই একুশ শতকের উপযোগী করে তুলে নতুন করে চাঙ্গা করে তোলার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন দুই দেশের নেতারাই। বিশ্বের সব মহাদেশেই কমনওয়েলথ-এর সদস্য দেশ ছড়িয়ে আছে। কাজেই এই পদক্ষেপ মুক্ত বাণিজ্যকে উৎসাহিত করবে।
ব্রেক্সিটের ফলে শুধু ইউরোপের বাজার হারিয়েছে ব্রিটেন। এ অবস্থায় তারা হতাশায় না ডুবে গিয়ে ভারতের মতো দেশের সঙ্গে বিশেষ মিত্রতা গড়ে তোলার কথা ভাবছে। ফলে ভারতের সামনে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে একটি গভীরতর, কৌশলগত স্তরের মিত্রতা গড়ার সুযোগ এসেছে। এতে দুদেশই লাভবান হবে। আর তার জন্য দুদেশএর তরফেই চেষ্টার খামতি নেই। মূল্যবোধ, আইনি ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠান সব দিক থেকেই দুদেশের পারস্পরিক নিবিড়তা এই পরিমার্জিত সম্পর্কের ভিতের কাজ করছে।
সেই গভীর ভিতের ওপর বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিনিময়, তহবিল সংগ্রহ, দুদেশের জনগনের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং সফট পাওয়ার রপ্তানির ক্ষেত্রে তারা সহযোগিতা গড়ে তুলতে চাইছে। ব্রেক্সিটের ফলে থেরেসা মে-এর সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলির পাশাপাশি অন্যান্য বানিজ্য মিত্রদেরও হারিয়েছে। এই সময়ে, ব্রিটিশ সরকারের প্রয়োজন এটি বিকল্প বাজার। ব্রেক্সিট ক্ষতি পূরণ করতে পারবে। ফলে ভারতের পক্ষে ব্রিটেনের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক সূচনার এটি ভাল সময়।
ব্রিটেন বিশ্বের অন্যতম আর্থিক শক্তিধর দেশ এবং প্রযুক্তিতেও এগিয়ে। অন্যদিকে ভারত বিশ্বের ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং ইকোনমি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এক বিলিয়নের ওপর ভোক্তা রয়েছে এই দেশে। কাজেই দুদেশের পারস্পরিক স্বার্থও মেলে খুব ভালভাবেই। আবার থেরেসা মে-এর গ্লোবাল ব্রিটেনের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর গ্লোবাল ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে খাপ খায়।
সাম্প্রতিক ব্রিটেন সফরে ব্রিটেনে বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের ভারত-ব্রিটেন সম্পর্কের 'লিভিং ব্রিজ' হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। সফরে বিভিন্ন পাবলিক সেক্টর ক্ষেত্রে চুক্তির পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ের একগাদা মউ স্বাক্ষর করেছেন দুই দেশের শীর্ষ নেতারা। এতে দুই দেশ এবং তাদের জনগণের মধ্যে যে সম্পর্ক স্থাপিত হবে তা পারস্পরিক বিশ্বাসের উন্নয়নের সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। যা ভবিষ্যতের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের ভিত্তি রচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কাজেই একদিকে ব্রিটেনের প্রয়োজন বিভিন্ন ক্ষেত্রের পণ্য এবং দক্ষতার জন্য নতুন বাজার। ভারতের যার অভাব নেই। আর হোয়াইট হাউসে এক খামখেয়ালি রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে ভারতের দরকার এক নির্ভরযোগ্য সহযোগী। এই পারস্পরিক চাহিদাই লন্ডন এবং নয়াদিল্লির সম্পর্কের প্রেরণা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। যাবতীয় বাধা ও দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারলে ব্রিটেন-ভারত সম্পর্ক বিশ্বে একটি গেমচেঞ্জিং গ্লোবাল পার্টনাপ হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে বলে মনে করছে দুই দেশই।