গ্লাসগো: যে শহরে বিশ্বকে বাঁচানোর উপায় নিয়ে চলছে শলা-পরামর্শ
রোববার সকালে ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে হোটেল থেকে বেরিয়ে একটি ট্যাক্সি থামিয়ে এক্সিবিশন সেন্টার - যেখানে জলবায়ু সম্মেলন হচ্ছে- যেতে চাইলে চালক সটান বলে দিলেন অসম্ভব, ওদিকে রাস্তা সব বন্ধ। আগ বাড়িয়ে পরামর্শ দিলেন ট্রেন ধরুন।
গ্লাসগো শহরের মূল কেন্দ্র থেকে মাইল দেড়েক দূরে ক্লাইড নদীর পাড়ে দৃষ্টিনন্দন যে বিশাল ভবনে জলবায়ু সম্মেলন চলছে তার আশেপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে রাস্তাঘাট গাড়ি চলাচলের জন্য বন্ধ।
অনেক রাস্তায় লোহার বেড়া তুলে মানুষ চলাচলের জন্যও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
ফলে সবচেয়ে কাছের ট্রেন স্টেশন থেকে ঘুরে-পেঁচিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে সম্মেলন ভবনে যেতে হচ্ছে।
রোববার সারাদিন এক্সিবিশন বাইরে রাস্তাগুলোতে মানুষ যত ছিল তার চেয়ে পুলিশের সংখ্যাই যেন বেশি দেখেছি, যদিও তখনও প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীরা শহরে পৌঁছুননি।
শুধু কপ সম্মেলন ভবন এলাকার আশপাশেই নয়, গ্লাসগো শহরের কেন্দ্রেও দুই পা বাড়ালেই পুলিশ নজরে পড়ছে। জর্জ স্কয়ার নামে শহরের যে খোলা চত্বরে মানুষজন জড় হয়ে গল্প-গুজব করেন সেখানে রোববার রাত ১০টাতেও কয়েক ডজন পুলিশ টহল দিচ্ছিল।
বিবিসি বাংলায় আরো পড়ুন:
'বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে কপ-২৬ সম্মেলন শেষ সুযোগ'
গ্লাসগোর কপ২৬ সম্মেলনে কী হবে এবং কেন এ সম্মেলন জরুরি?
জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জের সহজ-সরল ব্যাখ্যা
পরিবেশবাদীদের বিক্ষোভ
আজ (সোমবার) রাতের মধ্যেই একশরও বেশি দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী হাজির হবেন গ্লাসগোতে। ৩ তারিখ পর্যন্ত তারা থাকবেন। একসাথে এত বেশি ভিভিআইপি স্কটল্যান্ডের এই শহরে আগে কখনই আসেননি।
আর তাদের নিরাপত্তায় পুলিশের ১০ হাজার সদস্যকে গ্লাসগোতে মোতায়েন করা হয়েছে যেটাও আগে কখনই হয়নি।
পুলিশের মাথাব্যথার বড় একটি কারণ হবে 'এক্সটিংশন রেবেলিয়ান' এর মত কট্টর পরিবেশ আন্দোলনকারী গোষ্ঠীগুলো। স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় লেখা হচ্ছে নানা দেশ থেকে বিভিন্ন ব্যানারে কয়েক হাজার আন্দোলনকারী গ্লাসগোতে আসছেন।
অনেকে ইতিমধ্যেই এসে পড়েছেন। গত কয়েকদিন ধরে শহরের বিভিন্ন জায়গায় হঠাৎ হঠাৎ জড় হয়ে খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভ করছেন তারা। স্লোগান দিচ্ছেন, গান গাইছেন, সরকারগুলোকে গালিগালাজ করছেন।
যে কদিন বিশ্ব নেতারা শহরে থাকবেন, এসব আন্দোলনকারী বেশি সরব থাকবেন। পুলিশ যদি বাঁধা দেয় তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা গ্লাসগোর বাসিন্দাদের বাড়তি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিভিন্ন ব্যাংক এবং বহুজাতিক সংস্থা ভাঙচুরের ভয়ে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে।
অতিথীদের জন্য জায়গা নেই
কপ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সব মিলিয়ে সারা পৃথিবী থেকে ৩০ হাজারের মত মানুষ গ্লাসগো হাজির হয়েছেন।
যারা সরকারি ডেলিগেশনের অংশ হয়ে আসেননি এবং বিশেষ করে শেষ বেলায় ভিসা পেয়েছেন তারা জায়গা পেতে তারা হন্যে হয়ে থাকার জায়গা খুঁজছেন বলে অনেক কথা হচ্ছে।
শহরের সব হোটেল বহু আগে থেকেই বুক হয়ে গেছে। গ্লাসগোর অনেক মানুষ দু সপ্তাহের জন্য অন্য কোথাও গিয়ে নিজেদের বাড়ি-ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে বাড়তি কিছু পয়সা আয় করছেন।
এয়ারবিঅ্যান্ডবি সাইটে গ্লাসগোতে কিছুদিন আগ পর্যন্ত যে ভাড়া হাঁকা হয়েছে তা অবিশ্বাস্য। অনেক চেঁচামেচি লেখালেখির পর দাম কমেছে তবে অল্প যেসব জায়গা এখনও খালি তাও অনেক চড়া।
অনেক মানুষ, এমনকি অনেক সাংবাদিক বা সরকারি কর্মকর্তারাও, আশপাশের টো শহরে গিয়ে থাকছেন। ট্রেনে করে যাতায়াত করছেন। অনেকে ৬৫ কিমি দূরের শহর এডিনবারাতেও হোটেল ভাড়া করেছেন।
প্রতিদিন কোভিড টেস্ট
কোভিড প্যানডেমিকের ভূত পুরোপুরি ভর করে রয়েছে গ্লাসগোর সম্মেলনের ওপর।
সম্মেলন ভবনে ঢোকার অনুমতি পত্র বা আ্যাক্রিডিটেশন পাওয়ার সময় দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রমাণ দিতে হয়েছে।
তারপর, সম্মেলন ভবনে বা চত্বরে ঢোকার জন্য প্রতিদিন নিজে নিজে ল্যাটরাল ফ্লো টেস্ট অর্থাৎ নিজে নিজে কোভিড টেস্ট করে তার প্রমাণ দেখাতে হচ্ছে।
এ নিয়ে অনেক মানুষ বিপত্তিতে পড়েছেন, বিশেষ করে আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশেই নিজে নিজে ঘরে এ ধরণের কোভিড টেস্ট করার চল নেই। তারা অভ্যস্তও নন।
তব, ফ্লো টেস্টে কিট সরবরাহ করা হচ্ছে। সম্মেলন স্থল ছাড়াও শহরের পাঁচটি হোটেলে টেস্ট কিট রাখা হয়েছে। পরিচয়পত্র দেখিয়ে সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে। ভবনের ভেতর, বাইরে মানুষের হাতে হাতে দেখা যাচ্ছে কোভিড পরীক্ষার টেস্ট কিটের প্যাকেট।
আর ভবন চত্বরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। সে কারণে সম্মেলনের কেন্দ্রের ভেতর হাজার হাজার মানুষের চেহারা বোঝা যাচ্ছেনা। কারণ সবার মুখে মাস্ক।
ঢোকার সময় নিরাপত্তা রক্ষীরা মাস্ক নীচে নামাতে বলছেন যাতে আইডির ছবির সাথে চেহারা মিলিয়ে নিতে পারেন। তারপর বলে দিচ্ছেন মাস্ক যেন মুখে থাকে।
আবহাওয়ার চরম আচরণ
তবে কোভিড, থাকার জায়গার অভাব বা কেন শি জিন পিং আসছেন না এসব কথার চেয়েও কপের মিডিয়া সেন্টারে বেশি কথা হয়েছে আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থা বা ডব্লিউএমওর নতুন একটি রিপোর্ট নিয়ে যেখানে বলা হয়েছে গত সাত বছরে আবহাওয়ার যে চরম আচরণ চোখে পড়েছে তা নজির রেকর্ডে নেই। সাগরে, ভূপৃষ্ঠে সব জায়গার উষ্ণতা বেড়েছে।
এশিয়ার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে রেকর্ড অনুযায়ী ২০২০ সাল ছিল এশিয়ার সবচেয়ে উষ্ণ বছর। অন্তত যতদিন ধরে উষ্ণতার রেকর্ড রাখা হচ্ছে তার বিচারে। ১৯৮১-২০১০ পর্যন্ত সময়কালীন গড় যে তাপমাত্রা এশিয়ায় ছিল, তার চেয়ে ২০২০ সালের তাপমাত্রা ছি ১.৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আর এর এর ফলে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। বাস্তচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ এবং অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে শত শত কোটি ডলারের।
তার চারদিন আগে জাতিসংঘের আরেকটি রিপোর্ট বলছে পৃথিবীর দেশগুলো স্বল্প এবং মধ্যমেয়াদে কার্বন নিঃসরন কমানোর যে পরিকল্পনা করেছে তাতে ২০৪০ সাল নাগাদ বর্তমানের তুলনায় নি:সরণ বাড়বে ১৬ শতাংশ। এবং পৃথিবীর উষ্ণতা ১৮৫০ সালের তুলনায় ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ছে যার অর্থ মানব সভ্যতা মহা-বিপর্যয়ে পড়বে।
আবর্জনা থেকে কাগজ
রোববার সম্মেলন কেন্দ্রে যাওয়ার পথে রেল স্টেশনে কথা হচ্ছিল দক্ষিণ থেকে আসা জেন ম্যালোনির সাথে যিনি কাঠের বদলে আবর্জনা থেকে কাগজ বানানোর একটি প্রকল্পের সাথে জড়িত। তার সাথে ছিলেন নাইজেরিয়া থেকে পর্যবেক্ষক হিসাবে আসা পরিবেশ আন্দোলনকারী ডামিলোলা হামিদ বালুগুন।
তাদের জিজ্ঞেস করলাম এই সম্মেলন নিয়ে তাদের প্রত্যাশা কি? পৃথিবীর বিপদের কথা নেতারা কতটা গুরুত্ব দেবেন? যা করনীয় এখন থেকে তারা কি তা করবেন?
জেন ম্যালোনি বললেন সাংবাদিকদের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলা নিয়ে কোম্পানির কাছ থেকে কিছু বিধিনিষেধ তার ওপর রয়েছে। তবে বললেন - রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব যে রয়েছে তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
ডামিরোলার উত্তর ছিল - 'ভরসা ততটা নেই, তবে করতে চাই। আমি আশাবাদী।"