তুঙ্গে ভ্যাকসিন কুটনীতি, করোনা আবহে বাংলাদেশকে চিনা দৃষ্টি থেকে দূরে রাখতে শ্রীংলার ঢাকা সফর
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে চিনের প্রভাব ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তার মধ্যেই হঠাৎ দু'দিনের সফরে মঙ্গলবার প্রতিবেশি দেশে গেলেন বিদেশসচিব হর্ষবর্ধন শ্রীংলা। ঢাকাকে কাছে টানতে নিতে দিল্লির একটা কৌশলগত প্রচেষ্টা। যেটা একদিনের সংক্ষিপ্ত সফর হবে বলে মনে করা হচ্ছিল , সেটা দু'দিনের সরকারি সফরে পরিণত হল। এটা মার্চে কোভিড ১৯ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপ হওয়ার পর শ্রীংলার প্রথম বিদেশ সফর। সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন তিনি।
সফরের উদ্দেশ্য
একলাইনের বিবৃতিতে বিদেশমন্ত্রক বলেছিল, শ্রীংলা ঢাকায় "পারস্পরিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে এমন বিষয়ে আলোচনা ও সহযোগিতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।" যদিও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথার সময়, বাংলাদেশের বিদেশসচিব মাসুদ বিন মোমেন ভারতীয় বিদেশসচিবের সফর হঠাৎ হচ্ছে বলে মানতে চাননি। তিনি বলেন, শ্রীংলার সঙ্গে তাঁর বুধবার নির্ধারিত বৈঠকে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যেই ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ভারতে হচ্ছে, তা বাংলাদেশেও করার আবেদন জানান।
চিনের ঘনিষ্ঠ হয়েছে বাংলাদেশ
তবে এই সফর শুধু করোনা পরিস্থিতির নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ, এমনটা নয়। গত কয়েক মাসে চিনের ঘনিষ্ঠ হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ গ্রেটার রংপুর অঞ্চলে তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। চিনের কাছ থেকে ৮৫৩ মিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। যাতে সম্মত হয়েছে বেজিং। ৯৮৩ মিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পের আওতায় তিস্তার জল সংরক্ষণের জন্য একটি প্রকাণ্ড জলাধার তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
ভারতের পূর্বের প্রতিবেশীদের নিজেদের দলে টানছে চিন
চিন ভারতের পূর্বের প্রতিবেশীর প্রতিরক্ষা প্রকল্পগুলিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে কক্সবাজারের পেকুয়াতে বিএনএস শেখ হাসিনা ডুবোজাহাজ ঘাঁটি তৈরি এবং বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে দু'টি ডুবোজাহাজ দেওয়া। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই রয়েছে । ঢাকা চিনকে বঙ্গোপসাগরে নৌ-পরিকল্পনা রূপায়ণে সাহায্য করতে সক্ষম হয়েছে।
চিনা ফাঁদে বাংলাদেশের পা?
তবে নয়াদিল্লির পক্ষে আর একটি উদ্বেগের বিষয় হল যে, প্রধানমন্ত্রী হাসিনা চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগকেও গ্রহণ করেছেন। ভারত বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অংশ হতে চায়নি। কারণ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, চিন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর যা , পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যে দিয়ে যায়।
চিনের পাল্টা দাওয়াই ভারতের
তবে চিনের এই বাণিজ্যিক গিতিবিধির পাল্টা চাল দিয়েছে ভারতও। গত বছর, অক্টোবরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় সাতটি চুক্তি ও তিনটি প্রকল্প চূড়ান্ত হওয়ার পরও এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই চুক্তির মধ্যে রয়েছে, বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে যাতায়াতের জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মঙ্গলা বন্দরকে ব্যবহার করা, ত্রিপুরার সোনামুড়া ও বাংলাদেশের দাউদকান্দির মধ্যে জলবাণিজ্য পথ এবং নয়াদিল্লির ঢাকাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আট বিলিয়ন ডলারের ঋণ। দুটি দেশই রেল ও অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরায় চালু করতে উদ্যোগী হয়েছে। যাতে দু'দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। গত মাসেই ভারত-বাংলাদেশ রেলওয়েকে ১০টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ দিয়েছে।
বাংলাদেশের গুরুত্ব
এদিকে এই মাসের শুরুর দিকেই ভারত বিদেশমন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব (আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্মেলন) বিক্রম দোরাইস্বামীকে বাংলাদেশে নতুন হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করেছে। এই নিয়োগকে বেজিংয়ের ঢাকাকে কাছে টানার মোকাবিলা করতে কৌশলগত পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। মান্দারিন ও ফরাসি ভাষায় দক্ষ দোরাইস্বামী দিল্লিতে বিদেশমন্ত্রকের সদর দপ্তরে যুগ্মসচিব (উত্তর ও দক্ষিণ অ্যামেরিকা) এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান হিসেবেও কাজ করেছেন। তাই শ্রীংলার সফর যে শুধুমাত্র করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কিত নয়, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই কোনও বিশেষজ্ঞর।