ভারতে শিশু মৃত্যুর দায়ে অভিযুক্ত 'খুনী কুকুর'
ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যে গত নভেম্বর মাস থেকে কমপক্ষে ১২টি শিশু কুকুরের কারণে প্রাণ হারিয়েছে। যদিও অনেকে সেজন্য নেকড়ে এবং শেয়ালকে দোষারোপ করছে।
ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের একটি আম বাগানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলে দেখা যায় গাছের গায়ে এখনো রক্তের দাগ। তিনজন লোককে সাথে নিয়ে সেই পথে হেটে যাওয়ার সময় আত্মরক্ষার জন্য প্রত্যেকের সাথে নিতে হয় বড় বড় বাঁশের লাঠি। এখানে গত পয়লা মে খালিদ আলী নামের একটি শিশু কুকুরের হামলার শিকার হয়ে মারা গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ১১ বছর বয়সী শিশুটি স্কুলে যাওয়ার পথে গাছ থেকে ফল পাড়বার সময় কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমখামারী ৬৫ বছর বয়সী আমীন আহমেদ বলছিলেন, "আমি ভোরবেলা প্রতিবেশীদের বাগান থেকে জোরে চিৎকার শুনতে পাই। তারপর আমি যা দেখলাম তা ভয়াবহ। ছোট শিশুটিকে কুকুর আক্রমণ করায় সে একটি গাছে ওঠার চেষ্টা করে কিন্তু জন্তুটি তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামিয়ে আনে এবং তাকে কামড়ায়। আমি দৌড়ে গ্রামের লোকজনকে ডেকে আনি সাহায্যের আশায়"।
মাটিতে পুঁতে ১৬টি কুকুর হত্যার দায়ে একজনের জেল
কিন্তু গ্রামবাসীরা যতক্ষণ পৌঁছালেন ততক্ষণে খালিদ আলীর নি:শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। 'হত্যাকারী কুকুরের দল' বনের মধ্যে মিলিয়ে গেছে।
নিহত শিশুটির শোকাহত পরিবারটি এখনো আকস্মিক এ দুর্ঘটনার ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে পারছেনা।
"ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়। এত মারাত্মকভাবে তাকে জখম করা হয়েছে যে হাসপাতালে নেয়ার কোনও উপায় ছিলনা" কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন খালিদ আলীর মা মেহজাবীন।
ভারতে তিন কোটির বেশি ভাসমান কুকুরের আবাস।
কিন্তু শুধু খালিদ একাই সেদিন কুকুরের হামলার শিকার হয়নি। ২৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকার দূরত্বে আরও দুই শিশু খুনী কুকুরের কামড়ে প্রাণ হারিয়েছে।
প্রায় বারোটির মত শিশু সেদিন কুকুরের দলের হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও তারা মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে।
এসব ঘটনার পর আতঙ্ক এতটাই ছড়িয়েছে যে আতঙ্কিত বাবা-মায়েরা শিশুদের স্কুলে পাঠানো পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে।
এই এলাকা ভাসমান কুকুরগুলো হঠাৎ করে কেন "শিশু ঘাতক" হয়ে উঠলো?
সে প্রশ্নের উত্তর কারো কাছেই নেই বলে মনে হয়।
গ্রামবাসীদের অনেকের অভিযোগ, ওই এলাকায় এর আগে একটি অবৈধ কসাইখানা ছিল যেখান থেকে এসব প্রাণীর খাবার জুটতো। কিন্তু সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে এসব হামলা বেড়ে গেছে। যদিও এই তত্ত্ব খুব একটা জোরালো নয়। কেননা কমপক্ষে ছয়মাস আগে সেই কসাইখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আর প্রথম কুকুরের হামলায় আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে নভেম্বর মাসে।
এছাড়া জঙ্গল থেকে বিরল প্রজাতির মানুষ-খোকো কুকুর বেরিয়ে আসার গুজবও ছড়িয়েছে গ্রামবাসীর মধ্যে।
সাবির আলী যার একজন ভাতিজাও কুকুরের হামলার শিকার হয়েছে, তিনি বলেন, শিশুদের ওপর আক্রমণকারী এসব কুকুর গ্রামের ভেতর ঘুরে বেড়ানো সাধারণ ভাসমান কুকুর নয়। " এগুলো বড় ধরনের এবং চোয়ালগুলো শেয়ালের মতো"।
এই প্রাণীর সম্পর্কে খোঁজ-খবর করতে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড এবং ভারতীয় প্রাণী গবেষণা ইন্সটিটিউটের সদস্যরা ওই এলাকায় ক্যাম্পিং করছেন।
ভারতের প্রাণী কল্যাণ বিষয়ক বোর্ডের প্রধান প্রশিক্ষক বিবেক শর্মা এই রহস্যের কূল-কিনারা করতে জেলাটিতে অবস্থান করছেন। তাদের বিশ্বাস এইসব কুকুর প্রকৃতপক্ষে 'নেকড়ে" হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, মূল কালপ্রিট নেকড়ে হলে আমি অবাক হবো না, এবং তারা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। তারা ২০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করতে পারে। তারা দলবেঁধে হামলা চালায় এবং কেবল অল্পবয়সী টার্গেট করে।
উত্তর প্রদেশে এবং প্রতিবেশী বিহার রাজ্যে গত কয়েক বছরে অবশ্য নেকড়ের হামলার বেশ কয়েকটি ঘটনার খবর জানা গেছে। এই প্রাণী গবাদি-পশু এবং বাচ্চাদের ওপর চড়াও হয়েছিল।
এই অঞ্চলে কুকুরদের খাদ্য দানের জন্য সুপরিচিত একজন ব্যক্তি আসগর জামাল। কুকুর ও নেকড়ের মধ্যকার শঙ্কর-প্রজাতিকে দোষারোপ করেন তিনি।
" এগুলো ভিন্ন প্রজাতির কুকুর হবে, যদিও সেগুলো শিকারি প্রজাতির নয়, সেগুলো ভয়ংকর প্রজাতির।
পাল্টা-হামলা?
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যদিও নিশ্চিত নয় তবে তারা মনে করছে, ঘটনার রহস্য তারা প্রায় উদঘাটন করে ফেলেছে।
সিতারপুর থানারপুলিশ প্রধান আনন্দ কুলকানি বলেন, "প্রত্যক্ষদর্শীরা সবাই জানিয়েছেন যে, কুকুরগুলো শিশুদের ওপর আক্রমণ করেছে এবং আমরা ৫০টির বেশি এমন কুকুর ধরেছি। বিশেষজ্ঞরা তাদের আচার-আচরণ বিশ্লেষণ করে দেখছে।"
মেরে ফেলা কিংবা ধরে আনা কয়েক ডজন কুকুরের ছবি ও ভিডিও তুলে রাখা হয়েছে এবং তাতে ধারণা পাওয়া যায় উত্তর ভারত জুড়ে দেখা যায় যেসব ভাসমন কুকুর এগুলো তা-ই। কিন্তু প্রতিশোধমূলক হত্যার ভয়াবহ একটির ব্যাপার তৈরি হয়েছে।
" গত সপ্তাহে আমরা ছয়টি কুকুর মেরে ফেলেছি যদিও এগুলো বন্য এবং এভাবে তাদের পেছনে পেছনে ধাওয়া করা সহজ কাজ নয়। দিনের বেলা আমরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে জঙ্গলের ভেতর তাদের অনুসরণ করি" বলছিলেন গুরপালিয়া গ্রামের বাসিন্দা ওয়াসি খান।
সংবাদ মাধ্যমের চাপ বাড়তে থাকায় স্থানীয় কর্মকর্তারাও যত বেশি সম্ভব কুকুর ধরতে মাঠে নেমেছে। ড্রোন, ওয়্যারলেস সেট এবং নাইট ভিশন ডিভাইস সমৃদ্ধ ১৩টি ডগ-ট্র্যাকিং দল গঠন করা হয়েছে এবং তারা নিয়মিতভাবে কুকুর ধরার অভিযান চালাচ্ছে। তবে যারা পরিবারের প্রিয় সদস্যকে হারিয়েছে তাদের শোক সন্তাপ কাটেনি।
" আমি যদি কোনভাবে এই ধরনের নির্মম হামলার কথা বুঝতে পারতাম, আমি তাহলে আমার নয় বছরের ছেলেটাকে ঘরে আটকে রাখতাম", সন্তান হারানো শোকাহত একজন মা এভাবেই বিলাপ করছিলেন।''