ইতিহাসের সাক্ষী: কীভাবে যুদ্ধ করে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী ২৩শে জানুয়ারি পালন করছে সেদেশের মানুষ। গান্ধীর মতই সুভাষ বসুও ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটেনের বিরুদ্ধে লড়তে নাৎসী জার্মানি ও জাপানের সমর্থন নিতে গিয়েছিলেন। অনেকেই মনে করেন যে তিনি হয়তো ভারতের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিতে পারতেন। এ নিয়ে বিবিসির ক্লেয়ার বোওয়েস কথা বলেছেন সুভাষ বসুর আত্মীয় এবং একজন ইতিহাসবিদের সাথে। এ নিয়েই ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্ব।
"সুভাষ বসু এবং শরৎ বসু - এই দুই ভাই যদি আরো কিছুকাল বেঁচে থাকতেন তাহলে ভারত ভাগ হতো না" - বলছিলেন মাধুরী বসু - যিনি সুভাষচন্দ্রের ভাই শরৎ বসুর দৌহিত্রী ।
শরৎ বসু নিজেও ছিলেন একজন স্বাধীনতা-সংগ্রামী। তবে ভারতে এখনো ইতিহাসের একজন নন্দিত নায়ক হিসেবে দেখা হয় তার ভাই সুভাষ বসু-কে।
মাধুরী বসুর মতে, তিনি হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি, এমন একজন নেতা - যাকে এখনও ভারতের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ শ্রদ্ধা করেন।
"আর কোন নেতা সম্পর্কে এমনটা বলা যায় না - এমনকি গান্ধীর সম্পর্কেও না। তিনি প্রায় একজন ঈশ্বরতুল্য ব্যক্তিত্ব।" বলেন তিনি।
সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯৩৮ সালে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস পার্টির নেতা হয়েছিলেন।
তিনি এক ভাষণে বলেছিলেন, "বন্ধুগণ, আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যার মধ্যে অনেক সম্ভাবনার বীজ লুকিয়ে আছে।"
বিবিসি বাংলায় আরো পড়তে পারেন:
বিবিসি বাংলার জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি: ৫- সুভাষ চন্দ্র বসু
সুভাষ বসুর জীবনের শেষ মুহূর্ত সম্পর্কে যা জানা যায়
ভিয়েনায় যেভাবে বিদেশিনীর প্রেমে পড়েছিলেন সুভাষ বসু
প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি ভারতের ইতিহাসে এত গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা হলেও ভারতের বাইরে তিনি আজও এত কম পরিচিত কেন?
"এর কারণ আমি মনে করি ব্রিটিশ ইতিহাসবিদরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাসকে মুছে দিয়েছেন" - বলেন মাধুরী।
সুভাষ বসুর জন্ম ১৮৯৭ সালে । তাকে নিয়ে "রাজ, সিক্রেটস, রিভোলিউশন - দ্য লাইফ অব সুভাষ চন্দ্র বোস" নামে একটি বই লিখেছেন মিহির বোস, যার পদবী এক হলেও তিনি অবশ্য সুভাষ বোসের কোন আত্মীয় নন।
"তার জন্ম এক সচ্ছল পরিবারে - তিনি ছিলেন সেই লক্ষ লক্ষ ভারতীয়ের একজন যারা ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি, তাদের দালাল - যদিও এ শব্দটি ব্রিটিশরা ব্যবহার করতে চায় না। তারা বলে লয়ালিস্ট বা অনুগত" - বলেন মিহির বোস।
কিন্তু সুভাষ বসু ব্রিটিশ শাসনের অনুগত ছিলেন না। তিনি ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের চাকরি প্রত্যাখ্যান করে তার দেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধে নেমেছিলেন।
অন্য অনেকের মত তিনিও ১৯১৯ সালে অমৃতসরে শত শত শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের হত্যার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এর পর তিনি যোগ দেন গান্ধীর স্বাধীনতা আন্দোলনে।
সুভাষ চন্দ্র বসু: ১০০ গোপন নথি প্রকাশ্যে
সুভাষ বসুর গোপন নথি প্রকাশ করবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার
সুভাষ চন্দ্রের অতি গোপন নথি প্রকাশের সিদ্ধান্ত মোদীর
মিহির বোস বলছেন, সুভাষ বসু আসলে ছিলেন একজন দলছুট । তিনি গান্ধীর অহিংসার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না।
মাধুরী বসু বলেন, সুভাষ বসুর কথা ছিল, সহিংসতা যদি দরকার হয় তাহলে তা করতে হবে। কারণে তাদে শত্রু যে ব্রিটিশ রাজ - তারা অত্যন্ত সহিংস। তারা দু'শো বছর ধরে ভারতকে লুঠ করেছে, ভারতবাসীকে শোষণ করেছে।
গান্ধীর সাধে তার মতপার্থক্য সত্ত্বেও ভারতীয় জনগণের প্রিয় ছিলেন সুভাষ বসু।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার ঠিক আগে - ব্রিটিশ রাজ যখন ভারতে প্রথম নির্বাচনের সুযোগ দিল - তখন কংগ্রেস দল ভারতের সাতটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ পায়।
মিহির বোস বলছেন, তরুণ ভারতীয়দের মধ্যে সুভাষ বসুর পক্ষে ছিল বিপুল সমর্থন। তারা দল বেঁধে তার ভাষণ শুনতে সভায় যেতো। ব্রিটিশরা তার ভাষণের ওপর নজর রাখতো, এবং তিনি কি বলছেন, তার জন্য তার বিচার করা যায় কিনা - সেদিকে খেয়াল রাখতো।
সুভাষ বসু বললেন, "আমি আপনাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, , আপনারা শতশত, হাজার-হাজার জন মিলে ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে যান। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্তা পৌঁছে দিন, - যে বার্তা স্বাধীনতার বার্তা।"
তবে ভারত তখনো একটি উপনিবেশ, তার স্বাধীনতা তখনো অনেক দূরে। ১৯৩৯ সালে ব্রিটেন যখন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো, তখন তাদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য ডাকা হলো ভারতীয় সৈন্যদের। এতে কংগ্রেস পার্টি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়।
কিন্তু সুভাষ বসু এর মধ্যেই একটি সুযোগ দেখতে পেলেন। তার মনে হলো, তার শত্রুর শত্রু আসলে তার বন্ধু।
মিহির বোস বলছিলেন, সুভাষ বসুর মনে হলো ভারতের সিদ্ধান্ত নেবার মুহূর্ত এসে গেছে। তাদের উচিত হবে যে জাতিগুলো ব্রিটিশদের বিরোধী তাদের সবাইকে খুঁজে বের করতে সবকিছু করা - যাতে তারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে।
সুভাষ বসু বললেন, "ভারতের বাইরে - আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এখন ভারত এবং তার লক্ষ্যের অনুকুল বলেই মনে হচ্ছে। আমি আপনাদের প্রশ্ন করছি, যখন এই সুযোগ আপনাদের চোখের সামনে - তখন আপনারা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন?"
সুভাষ বসু তখন বিক্ষোভের আয়োজন করতে লাগলেন।
তার অনুসারীদের বললেন - তারা যেন হাতে অস্ত্র তুলে নিতে, এবং স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকে।
"আমি নিশ্চিত যে আপনারা সম্ভব সবকিছু করার জন্য প্রস্তুত । ভারত যাতে স্বাধীন হতে পারে, যে জন্য যদি কখনো প্রয়োজন হয় - তখন প্রাণ দেবার জন্যও তৈরি থাকবেন। "
এই সময়টাতেই গান্ধী ও সুভাষ বসুর মধ্যেকার রাজনৈতিক মৈত্রী ভেঙে গেল।
সুভাষ বসু চেষ্টা করতে লাগলেন কিভাবে তার বিপ্লবী বার্তা আরো বেশি করে মানুষকে শোনানো যায়।
মাধুরী বসু বলেন, স্বাধীনতার দাবিতে কেউ উঠে দাঁড়াচ্ছে না দেখে তিনি হতাশ ছিলেন। তার মনে হলো, তাকে ভারত ছেড়ে যেতে হবে, এবং ব্রিটেনের শত্রু দেশগুলোর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে হবে।
একজন মুসলিমের ছদ্মবেশ ধরে সুভাষ বসু ১৯৪১ সালে ব্রিটিশদের চোখ এড়িয়ে ভারত ত্যাগ করলেন এবং নানা পথ ঘুরে নাৎসী জার্মানিতে পৌছালেন। তিনি বার্লিনে এক বছর থাকলেন, এবং সেখানকার রেডিও থেকে ভারতের স্বাধীনতার স্বপক্ষে বার্তা প্রচার করতেন।
শেষ পর্যন্ত তার এডলফ হিটলারের সাথেও সাক্ষাৎ করার সুযোগ হলো সুভাষ বসুর। সেই বৈঠক অবশ্য ভালো যায়নি।
তিনি হিটলারের কাছে অভিযোগ করলেন - 'আপনার বই 'মাইন কাম্ফ'-এ ভারতীয়দের সম্পর্কে কিছু বর্ণবাদী মন্তব্য আছে। আপনি কি সেগুলো বাদ দেবেন?"
"খোলাখুলি বলতে গেলে বলতে হয়, সেটা ছিল একটা বিপর্যয়কর বৈঠক" - বলেন মিহির বোস, "সুভাষ বসু নাৎসী বা ফ্যাসিস্ট ছিলেন না । আমার মনে হয়, জার্মানির সাথে একটা জোট গঠনের চেষ্টাটা ছিল একটা ঐতিহাসিক ভুল।"
সুভাষ বসু এর পর এশিয়ার পথে যাত্রা করলেন। ১৯৪২ সালে হিটলারের অক্ষশক্তির অন্যতম জাপান তখন যুদ্ধে বিরাট সাফল্য পাচ্ছিল। তারা বেশ কিছু সাবেক ইউরোপিয়ান উপনিবেশের নিয়ন্ত্রণ দখল করে নিয়েছিল।
পূর্ব এশিয়ায় বসবাসরত ভারতীয়দের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু।
সাবেক অক্ষশক্তি-নিয়ন্ত্রিত পূর্ব এশিয়ায় বসবাসরত ভারতীয়দেরকে সুভাষ বসু তার নবগঠিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আজাদ হিন্দ ফৌজে নিয়োগ করতে লাগলেন।
তিনি বললেন, "আমি মনে করি যে অক্ষশক্তি নিয়ন্ত্রিত দেশগুলোর বাসিন্দা ভারতীয়রা তাদের মাতৃভূমির জন্য সর্বোচ্চ সেবা দেবে।"
মাধুরী বসু বলছিলেন, "ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির অফিসারদের সাথে সুভাষ বসুকে নিয়ে কথা হয়েচিল। আমি যখন ছোট, তখন তাদের একজন আমাকে বলেছিলেন, তোমার ঠাকুর্দা যদি আমাকে পাহাড়ের ওপর থেকে ঝঁপিয়ে পড়তে বলেন - তামি তাই করবো। "
সুভাষ বসু আশা করেছিলেন যে আইএনএ, জাপানীদের সাথে নিয়ে যদি ব্রিটিশ-ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে - তাহলে স্বাথীনতাকামী ভারতীয়দের ব্রিটিশ বাহিনী ত্যাগ করতে অনুপ্রাণিত করবে এবং ওই বাহিনীতে বিদ্রোহ হবে।
তিনি বলেছিলেন, "ভারতকে স্বাধীন করার দায়িত্ব আমাদের এবং শুধু আমাদেরই।"
কিন্তু তা বাস্তবে পরিণত হয়নি। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার কিছু দিন আগে - ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে - বর্তমান তাইওয়ানে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন সুভাষ বসু। তার মৃত্যুকে ঘিরে এখনো নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচলিত আছে।
অন্যদিকে ভারতে সংবাদ মাধ্যমের ওপর তখন ছিল ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ। খুব কম লোকই আইএনএ বা আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কে জানতো।
ব্রিটিশরা যখন আইএনএ'র অফিসারদের রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে বিচারের কাঠগড়ায় তুললো তখনই তা সবাই জানতে পারলো।
এই বিচারে আসামী হয়েছিলেন, একজন হিন্দু, একজন মুসলিম ও একজন শিখ।
মাধুরী বসু বলছিলেন, "এটা ছিল ম্যাজিকের মত। ব্রিটিশরা আসলে তাদের অজান্তে সুভাষের কাজটা করে দিয়েছিল। মানুষ সেই সৈনিকদের কাহিনি জানতে পারলো, জানতে পারলো কিভাবে তারা ভারতের স্বাধীনতার জন্য ইন্দো-বার্মা ফ্রন্টের যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন।"
ভারতের মানুষের কাছে সুভাষ বসুর গুরুত্ব এর পরের দশকগুলোতে ক্রমাগতই বেড়েছে।
অনেকে মনে করেন তিনি হয়তো ১৯৪৭ সালে ভারতের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনা দেশভাগ ঠেকাতে পারতেন।
"সুভাষ বসু কাহিনির সাথে যুক্ত হয়ে আছে দেশবিভাগের ভয়াল স্মৃতি" - বলছিলেন মিহির বোস।
"তিনি যদি ফিরে আসতে পারতেন এবং ভারতের তৎকালীন প্রায়-বৈপ্লবিক পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারতেন - তাহলে হয়তো ব্রিটিশরা যেভাবে ভারত-ভাগ করে বিদায় নিয়েছিল - তাদের পক্ষে তা করা কঠিন হয়ে পড়তো। এটা খুবই সম্ভব ছিল।"
ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্বটি পরিবেশন করেছেন পুলক গুপ্ত।