বিদেশি কই পাঙ্গাস যেভাবে বদলে দিয়েছে বাংলাদেশে মাছ উৎপাদনের চিত্র
বিদেশি কই পাঙ্গাস যেভাবে বদলে দিয়েছে বাংলাদেশে মাছ উৎপাদনের চিত্র
বাংলাদেশে বর্তমানে বছরে মাছের চাহিদা আছে প্রায় ৪২ লাখ টন এবং জনপ্রিয় কয়েকটি মাছের ব্যাপক উৎপাদন সম্ভব হওয়ার কারণে চাহিদা পূরণের পর প্রতিবছর কিছুটা উদ্বৃত্তও থাকে।
গবেষকরা বলছেন অন্তত তিনটি মাছই দেশের মাছ উৎপাদনের চিত্র পাল্টে দিয়েছে। তবে এর মধ্যে দুটি মাছ দেশীয় হলেও এর বিস্তার সম্ভব হয়েছে বিদেশি প্রজাতির কারণে।
এখন বাজারে সবচেয়ে সহজলভ্য এই তিনটি মাছ হলো- কই, পাঙ্গাশ আর তেলাপিয়া।
ময়মনসিংহের মৎস্য উৎপাদক ও ব্যবসায়ী আব্দুল কাদির তরফদার বলছেন তেলাপিয়া বাংলাদেশের নিজস্ব মাছ নয়, তবে কই ও পাঙ্গাশ দেশি মাছ যা হারিয়ে যেতে বসেছিলো।
"বিদেশি প্রজাতির কই ও পাঙ্গাশ আসায় মাছ দুটো সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য হয়েছে। আর দেশি জাতের মাছে গ্রোথ খুব কম। সে তুলনায় বিদেশি প্রজাতির কই ও পাঙ্গাশ দ্রুত বর্ধনশীল। এ কারণেই চাষের ক্ষেত্রে তেলাপিয়ার বাইরে এ দুটো মাছ বেশি আকর্ষণীয় খামারিদের কাছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, দেশি জাতের কই এখন বিপন্ন প্রজাতির মাছ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৩৪ লাখ ৯৭ হাজার মেট্রিক টন স্বাদু পানির মাছ উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে কই মাছ থেকে আসে ৫৩ হাজার ৫৫৩ মেট্রিক টন।
যদিও এর মধ্যে দেশি জাতের কই মাছের পরিমাণ কত তার হিসেব পাওয়া কঠিন।
মৎস্য গবেষক ও খামারিদের মতে ৯০ এর দশক থেকেই দেশি জাতের বিভিন্ন জাতের মধ্যে কই মাছও ব্যাপকভাবে কমতে থাকে।
বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:
যেভাবে ক্ষতিকর হয়ে উঠছে বাংলাদেশের চাষের মাছ
কিভাবে বাজারে আসছে পিরানহা ও আফ্রিকান মাগুর?
যেভাবে ফিরে এলো প্রায় বিলুপ্ত বৈরালি, গজার এবং আরো মাছ
মা ইলিশ রক্ষা: ভারতীয় মাছধরা নৌকা সরাচ্ছে ভারতের স্থল ও বিমান ইউনিট
পরে ২০০৩ সালে থাই কই মাছের চাষ শুরু হয় এবং এর কয়েক বছর পর ২০১১ সালে ভিয়েতনামের কই মাছ চাষ শুরু হয়।
থাই কই মাছের দৈহিক বৃদ্ধি দেশি কই মাছের দ্বিগুণ, উৎপাদন খরচও কম। আবার হেক্টর প্রতি ভিয়েতনামের কই মাছ পাওয়া যায় ১৫ মেট্রিক টন।
এ সব কারণেই খামারিরা দেশি ও থাইল্যান্ডের কই মাছ বাদ দিয়ে পরে ভিয়েতনামের কইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন বলে বলছেন মিস্টার তরফদার।
আবার ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে পাঙ্গাশের উৎপাদন ছিল চার লাখ ৫৩ হাজার ৩৮৩ টন। যার বাজার মূল্য সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
বাজারে এখন সবচেয়ে সহজলভ্য মাছগুলোর একটি হলো পাঙ্গাশ, যা চাষের পাঙ্গাশ হিসেবেই পরিচিত।
তবে এখনো দেশীয় নদী কিংবা প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া পাঙ্গাশ অনেক দামেই বিক্রি হয়।
আব্দুল কাদির তরফদার বলছেন এখন থাই পাঙ্গাশের কারণে মাছটি হারানোর হাত থেকে রক্ষাই পায়নি, বরং গণমানুষের কাছে সহজলভ্য হয়েছে।
মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের নদী কেন্দ্র, চাঁদপুরে ১৯৯০ সালে কৃত্রিম প্রজননে সর্বপ্রথম থাই বা সূচী পাঙ্গাশের পোনা উৎপাদন ও পরবর্তীতে পুকুরে চাষ শুরু হয়।
এরপর সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পাঙ্গাশ চাষ প্রযুক্তি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশের আমিষ প্রাণীজ চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে।
মূলত পাঙ্গাশের ক্ষেত্রে দেশি জাতের পাঙ্গাশ ও থাই পাঙ্গাশই বিশেষভাবে জনপ্রিয় বাংলাদেশের মানুষের কাছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালিহা হোসেন মৌ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করেই খামারিরা কই ও পাঙ্গাশের বিদেশী প্রজাতির দিকে ঝুঁকেছে।
তিনি বলেন কই, পাঙ্গাশ ও তেলাপিয়া এতো সহজলভ্য হয়েছে এসব কারণেই যদিও তেলাপিয়া বিদেশি প্রজাতি নয় বরং জেনেটিক্যালি ইমপ্রুভড করা হয়েছে।
তবে তেলাপিয়া বাংলাদেশের নিজস্ব মাছ নয় বলেই বলছেন তিনি।
এশিয়াটিক সোসাইটি প্রণীত বাংলাপিডিয়া বলছে, ১৯৫৪ সালে তেলাপিয়া বাংলাদেশে এসেছিলো প্রথম বিদেশি মাছ হিসেবে।
আবার ইউনিসেফ ও মৎস্য অধিদপ্তর যৌথ প্রকল্পের আওতায় ১৯৭৪ সালে থাইল্যান্ড থেকে আরেক জাতের তেলাপিয়া নিয়ে আসে। এছাড়া মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট থাইল্যান্ড থেকে আরও কিছু তেলাপিয়া আমদানি করেছিল ১৯৮৭ সালে।
এর বাইরে ফিলিপাইন থেকে ১৯৯৪ সালে খামারে জন্মানো বংশগতভাবে উন্নত তেলাপিয়া বাংলাদেশে আনা হয়।
মালিহা হোসেন বলছেন, "মনে রাখতে হবে আগের মতো পুকুর, খাল, বিল কিংবা জলাশয় নেই। দিন দিন আরও কমছে। তাই কইয়ের মতো দেশি মাছ কমে আসবে এটাই স্বাভাবিক। তবে প্রথমে থাই ও পরে ভিয়েতনাম থেকে আসা কই থেকে খামারিরা ব্যাপক সফল হয়েছে। মাছের বাজারে তারই প্রতিফলন ঘটেছে ।"
মূলত থাই প্রজাতির কইয়ের চেয়ে বেশি বর্ধনশীল বলা হয় ভিয়েতনামের কই মাছকে। পুকুরে চার মাসের মতো সময় চাষ করে গড়ে প্রতিটি মাছ প্রায় আড়াইশো গ্রাম আকার ধারণ করে, যা থাই কিংবা দেশি জাতের কই-এর তুলনায় অনেক বেশি।
মাছ গবেষকরা বলছেন বিদেশি প্রজাতির মাছ এসে যেমন উৎপাদন চিত্র পাল্টে দিয়েছে, তেমনি বিলুপ্তির পথে থাকা বেশ কিছু মাছকেও গবেষণার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা।
ফলে টেংরা ও পাবদাসহ বেশ কিছু বিলুপ্তির পথে থাকা মাছ আবার ব্যাপক উৎপাদন হচ্ছে, যদিও বাজারে তার দাম অনেক বেশি। চেষ্টা করা হচ্ছে দেশি জাতের কই কিভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়েও।
কিন্তু অনেক গবেষক আবার মনে করেন, বিদেশি প্রজাতির মাছের কারণেই কমে যাচ্ছে দেশীয় জাতের মাছ।