ভোজ্য তেল: ঈদের আগে পাম অয়েল এবং সয়াবিন তেলের বাজার আবার অস্থির, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
বাংলাদেশে ঈদের আগে আবারও পাম অয়েল এবং সয়াবিন তেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
ক্রেতারা অভিযোগ করেছেন, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ভোজ্য তেল বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এবং বেশি দাম দিয়েও খুচরা বাজারে অনেক দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না।
খুচরা বা পাইকারি বিক্রেতারা অভিযোগ করেছেন, তেল মিলগুলো বা আমদানিকারকরা বাজারে তেল সরবরাহ কমিয়ে সংকট সৃষ্টি করেছে।
আমাদানিকারক বা মিলগুলোর পক্ষ থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
তবে সরবরাহে সংকট সৃষ্টির অভিযোগের ব্যাপারে আজ কয়েকটি মিলে অভিযান চালানো হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলেছেন, ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি নিষিদ্ধ করার পর দেশের বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে কিনা- সে ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
আরও পড়ুন:
তেলের ভোগ বেড়েছে বাংলাদেশে - ভোজ্য তেল নিয়ে যেসব তথ্য জানা জরুরি
বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট কেন, কী বলছে সরকার?
বাংলাদেশ চিনি, তেল, ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যে কবে স্বনির্ভর হবে
রমজান শুরুর আগে বাংলাদেশের বাজারে পাম অয়েল এবং সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে একটা সংকট তৈরি হয়েছিল।
তখন সরকার হস্তক্ষেপ করে দাম নির্ধারণ করার পর সেই দফায় বাজার নিয়ন্ত্রণে আসে।
এখন আবার ঈদের আগ মুহূর্তে ভোজ্য তেলের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।
খুচরা বাজারে দাম চড়া
ঢাকায় চাকরিজীবী সাবরিনা মমতাজ নিয়মিত বাজার করেন। তিনি দেখছেন গত কয়েকদিনে হঠাৎ করে সয়াবিন এবং পাম অয়েলের দাম লিটার প্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তিনি বলেছেন, বেশি দাম দিয়েও অনেক মুদি দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। এমন অভিজ্ঞতাও তার হয়েছে।
"আমরা যখন বাজারে যাই, সব দোকানে যে তেল ঠিকমত পাব, সেটাও বলা মুশকিল। কারণ এক দোকানে থাকলে অন্য দোকানে স্টকে তেল নাই। যে দোকানে তেল আছে, সে দোকানে তেল প্রতি লিটার ১৭৫ টাকা বা ১৮০ টাকায় বিক্রি করছে। ফলে সাধারণ মানুষের জন্য পরিস্থিতিটা কষ্টকর," বলছেন সাবরিনা মমতাজ।
তেল মিলকে দুষছেন খুচরা এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা
ভোজ্য তেলের বাজারে এই পরিস্থিতির জন্য বিক্রেতারা চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকার কথা বলেছেন।
ঢাকায় মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের একাধিক খুচরা বিক্রেতা অভিযোগ করেছেন, তারাও বেশি দাম দিয়ে পর্যাপ্ত তেল সরবরাহ পাচ্ছেন না।
ঢাকার বড় পাইকারি বাজার মৌলভীবাজার থেকে ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা তেল সরবরাহে সংকটের জন্য বড় আমদানিকারক বা তেল মিলগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।
"মিল মালিক যারা উৎপন্ন এবং বিপণন করেন, তারা বাজারে পর্যাপ্ত তেল সরবরাহ করছে না এবং যতটা সরবরাহ করা হচ্ছে, তা সরকারের নির্ধারিত দামে নয়। সেজন্য তেলের বাজার অস্থির হয়েছে," অভিযোগ পাইকারি ব্যবসায়ী গোলাম মাওলার।
বিবিসি বাংলায় আজকের আরো খবর:
রাশিয়ার ভেতরে বিস্ফোরণ, ইইউর দুটি দেশে রুশ গ্যাস বন্ধ
সেরা খাবারের ছবির পুরস্কার জিতল কাশ্মীরের কাবাব, তালিকায় বাংলাদেশের একাধিক ছবি
র্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারত কি কোন সহায়তা করতে পারে
রমজান মাসে ভোজ্য তেলের বাড়তি চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে আড়াই লাখ টন তেলের যোগান রাখার টার্গেট করা হয়েছিল বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
স্বাভাবিক সময়ে এক মাসে এই চাহিদা থাকে এক লাখ টন।
রমজানে তেলের চাহিদা যা ধরা হয়, তার ৬৫ শতাংশই হচ্ছে পাম অয়েল।
এই পাম অয়েল আমদানির জন্য বাংলাদেশ মূলত ইন্দোনেশিয়ার ওপর নির্ভরশীল এবং ৮০ শতাংশই সেখান থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে।
কয়েকদিন আগে ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করে দেবার ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের তেলের বাজার অস্থির হয়েছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবও রয়েছে বলে আমদানিকারকদের অনেকে বলছেন।
তবে তেল মজুদ থাকা সত্বেও সরবরাহে সংকট সৃষ্টির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আমদানিকারকরা।
'অ্যাবনরমাল চাহিদা'
অপরিশোধিত ভোজ্য তেল আমদানি করে তা দেশে আবার উৎপাদন করে যে মিলগুলো, সেই মিলগুলোর মধ্যে অন্যতম টি কে গ্রুপের পরিচালক সফিউল আথার তাসলিম বলেছেন, মিলগুলোর বাইরে কোথাও সরবরাহে সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে কিনা- এমন সন্দেহ তারা করছেন।
"মিলগুলো থেকে সরবরাহ আগের মতই আছে। বরং আমরা গত কয়েকদিনে অস্বাভাবিক চাহিদা দেখছি।"
সফিউল আথার তাসলিম বলেন, "চাহিদাটা অ্যাবনরমাল মনে হওয়ার অনেক কারণ আমরা পেয়েছি। যেমন একজন ডিলার আমার কাছ থেকে ছয়মাসে ভোজ্য তেল নিয়েছে দুইশো কার্টুন। সে এখন একদিনে এক সপ্তাহের জন্য চাচ্ছে পাঁচশো কার্টুন।
"এরকম অ্যাবনরমাল চাহিদা কিন্তু আমরা পাচ্ছি। আমরা কিন্তু কখনও ঈদের আগে এরকম পরিস্থিতি দেখি নাই," বলেন সফিউল আথার তাসলিম।
সরবরাহে সংকট সৃষ্টির অভিযোগের প্রেক্ষাপটে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বুধবার চট্টগ্রামে এবং নারায়ণগঞ্জে কয়েকটি মিলে অভিযান চালিয়েছে।
এই অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেছেন, তাদের অভিযানে মিলগুলোর সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার অভিযোগের প্রমাণ এখনও মেলেনি।
"পরিস্থিতি নিয়ে এখন একটা ব্লেমগেম হচ্ছে। কিন্তু আমরা চট্টগ্রামে এস আলম গ্রুপের মিলে গিয়ে দেখেছি। সেখানে সরবরাহে কোন ঘাটতি পাওয়া যায়নি," বলেন মি: সফিকুজ্জামান।
মজুদদারির বিরুদ্ধে অভিযান চলবে
ভোজ্য তেল অন্য কোন পর্যায়ে মজুদ করা হয় কিনা- সে ব্যাপারেও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ভোজ্যতেলের বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকার যে পরিবর্তন এনেছিল, সেই ব্যবস্থায় কোন সমস্যা হয়েছে কিনা-তাও খতিয়ে দেখার কথা বলছেন কর্মকর্তারা।
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেছেন, "ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতো মূলত ঢাকার মৌলভীবাজার এবং চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ী বা ডিলাররা। সেটা আমরা ভেঙে দিয়েছি।"
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরও বলেন: "এর ফলে দেশে এখন যেকোন জায়গায় মিল থেকে সরাসরি তেল সরবরাহ করা হয়। এ কারণে কোন কোন পর্যায়ে হয়তো তেল মজুদ করে রাখতে পারে। সে ব্যাপারে আমরা তথ্য নিচ্ছি এবং এর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলবে।"
সরকারের বিকল্প ভাবনা কী
কিন্তু শুধু অভিযান চালিয়ে সংকট সামালনো সম্ভব কিনা- সেই প্রশ্ন রয়েছে।
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান অবশ্য বলেছেন, বিকল্প হিসাবে ইন্দোনেশিয়ার ওপর নির্ভরশীল না থেকে মালয়েশিয়া থেকে পাম অয়েল আমদানি বাড়ানোর বিষয়ে এখন গুরুত্ব দেয়া হবে।
এছাড়া পাম অয়েল এবং সয়াবিন তেলের বাইরে অলিভ অয়েল এবং সূর্যমুখী তেল সহ অন্য ধরনের ভোজ্য তেল আমদানিতে শুল্ক কমানোর বিষয়ও সরকারের বিবেচনায় রয়েছে।
এসব বিষয়ে বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ট্যারিফ কমিশনের সাথে বৈঠক করার কথা রয়েছে।