ভারতকে ছাড়াই পাড়ি দিল আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়ার 'জাহাজ'; বিদেশনীতিতে বড় ধাক্কা নয়াদিল্লির
দীর্ঘ সাড়ে সতেরো বছর আফগানিস্তানের পাঁকে হাঁক-পাক করতে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত বুঝেছে যে শুধুমাত্র সামরিক পথে আফগানিস্তানে শান্তি ফিরবে না। প্রয়োজন সত্যিকারের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। আর সেই মতো তালিবানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্তারা কাতারের রাজধানী দোহায় একের পর এক বৈঠক করছেন। মার্কিনিদের পাশাপাশি রাশিয়া ও চিনও রয়েছে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে।
সোমবার, ২৯ এপ্রিল, আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিযুক্ত আমেরিকার বিশেষ প্রতিনিধি জলমে খলিলজাদ ও অন্যান্যরা পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে গিয়ে সেখানকার উচ্চপর্দস্থ আধিকারিকদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। তালিবান-মার্কিন বৈঠকের পরে পাকিস্তানের সঙ্গেও ওয়াশিংটনের আলোচনাকেও যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। অর্থাৎ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ তাদের বৈরী রাশিয়া ও চিন এমনকী পাকিস্তানও আফগানিস্তানের শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় রয়েছে যথেষ্ঠ অর্থে। কিন্তু ভারত নেই।
এত চিলচিৎকারের পরেও ভারত আফগানিস্তানে উপেক্ষিতই
অথচ আফগানিস্তানে ভারতের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে কম আলোচনা-বিতর্ক হয়নি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে। অতীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন আফগানিস্তানে ভারতকে আরও বড় ভূমিকা পালন করতে হবে; এমনকী দরকার পড়লে কাবুলের মাটিতে পাকিস্তানের বিকল্প হিসেবেও ভারতের কথা বলেছেন ওয়াশিংটনের দাদারা।
গতবছর চিনের উহানে যখন সেদেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আলাপচারিতা হয় দু'দেশের মধ্যে সম্পর্ক ভালো করার লক্ষ্যে, তখন সেখানে আফগানিস্তানে বেইজিং ও নয়াদিল্লির মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার কথাও বলা হয়। আফগানিস্তানে পরিকাঠামো বা সামরিক সহায়তা (সরাসরি যুদ্ধে যোগদান নয়) বা রাজনৈতিক পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারতের অবদানের কথা এক কথাতেই স্বীকার করে নেন সবাই; কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়ার বিষয়ে ভারতের কোনও গুরুত্বই দেখা যাচ্ছে না।
আসলে আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকা বরাবরই 'সফ্ট পাওয়ার' কেন্দ্রিক। সরাসরি যুদ্ধ-সংঘাতে না ঢুকে ভারত কাবুলের নির্বাচিত সরকারকে অন্য নানাভাবে সাহায্য করার পথে এগিয়েছে চিরকালই। লক্ষ্য, আফগানিস্তানে একটি মজবুত সরকার এলে তাতে পাকিস্তানকে যেমন একদিক থেকে চাপে রাখা যাবে, তেমনই তালিবান ও বিভিন্ন চরমপন্থী গোষ্ঠীকেও আস্তে আস্তে নির্মূল করা সম্ভব হবে।
কিন্তু, সাড়ে ১৭ বছর টানা আফগানিস্তানের মাটিতে কাটিয়েও মার্কিন-নেতৃত্বাধীন পশ্চিমি বিশ্ব বুঝেছে যে রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কার্যত অসম্ভব। আর এই শান্তিপ্রক্রিয়াতে সামিল করতে হবে তালিবান এবং পাকিস্তানকেও, কারণ তাদের উপস্থিতি এই পুরো বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারত তো আফগানিস্তানে রাজনৈতিক পুনর্নির্মাণের লক্ষ্যেই এগিয়েছিল; কেন তবে তাহলে তারাই ব্রাত্য হয়ে রইল এই সামরিক প্রক্রিয়াতে?
ব্যর্থ ভারতের বন্ধু কাবুলের নির্বাচিত সরকারই
ভারতের সমস্যা আসলে অন্য জায়গায় আর তার দোষ যে শুধু ভারতেরই, তা ঠিক বলা চলে না। বরাবরই ভারতের আফগানিস্তান নীতি ছিল সেদেশের নির্বাচিত সরকারকে সমর্থন করা। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হামিদ কারজাই এবং এখন আশরাফ গনির সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সবসময়ই ভালো। কারজাই-এর তো ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল ভারতের সঙ্গে। যেহেতু কাবুলের প্রশাসন চালাতে পাকিস্তান-সমর্থিত তালিবানের মোকাবিলা করতে এই দুই নেতার সরকারের ইসলামাবাদের সঙ্গে যথেষ্ঠ মনোমালিন্য হয়, তাই স্বাভাবিকভাবে ভারতই হয়ে ওঠে তাঁদের বন্ধু। অন্যদিকে, গনণতান্ত্রিক পশ্চিমের সমর্থন পাওয়া কারজাই বা গনির সঙ্গে গণতান্ত্রিক ভারতের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক। পাশাপাশি, রাজনৈতিক ছাড়াও নয়াদিল্লির সঙ্গে কাবুলের অর্থনৈতিক সম্পর্কও ভালো। তাই ওয়াশিংটন-কাবুল-নয়াদিল্লি অক্ষের কোনও ব্যতিক্রম ঘটবে না বলেই ধরা হত।
কিন্তু সাম্প্রতিকতম আফগান শান্তি প্রক্রিয়াতে এখন কাবুলের সরকারই অনেকটা একঘরে হয়ে পড়েছে। সামনেই আফগানিস্তানে ভোট কিন্তু দুর্নীতি, দুর্বল সামরিক বাহিনী এবং অন্তর্কলহের জন্যে কাবুলের সরকার ক্রমেই নিজের জমি হারিয়েছে খোদ দেশের মধ্যেই। তালিবান ফের মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে; অধিকার করে নিচ্ছে দেশের অনেক অংশই আর তাতেই ঘুম ছুটেছে বহিরাগত শক্তিগুলির। যেহেতু প্রায় দুই দশক পরেও কাবুলের প্রশাসনের দ্বারা আফগানিস্তানের মাটিতে ইতিবাচক কিছু ঘটেনি, তাই সেই সরকারের উপরে আর নির্ভর করে তালিবানকে বশ মানবার পন্থায় আত্মবিশ্বাসী হতে পারছে না বাইরের শক্তিগুলি।
আফগানিস্তানের এই শান্তিপ্রক্রিয়াতে যদি সেখানকার নির্বাচিত সরকারই কোনও ভূমিকা না নিতে পারে, তবে ভারতের পক্ষে কতটা কী করা সম্ভব? নয়াদিল্লির কি তাহলে উচিত তালিবানের সঙ্গেও যোগাযোগ তৈরী করে আরেকটি কূটনৈতিক দরজা খোলা? যদিও তালিবানের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে ভারত বরাবরই ছুঁৎমার্গ দেখিয়ে এসেছে।
কাবুলের সরকারের গুরুত্বহ্রাস ভারতের পক্ষে সুখবর নয়
কাবুলের সরকারের গুরুত্বহ্রাস কিন্তু ভারতের পক্ষে সুখবর নয়। কারণ একদিকে তা ওই অঞ্চলে ফের অস্থিরতা বাড়াবে এবং কাশ্মীরের সুরক্ষায় বড় চ্যালেঞ্জ তৈরী করবে। অন্যদিকে, তালিবান যদি ফের ক্ষমতাসীন হয় আফগানিস্তানে আগামী দিনেই, তাহলে তা পাকিস্তানকে মনোবল যোগাবে এবং ভারত-ইরান-আফগানিস্তানের মধ্যে তৈরী হওয়া নতুন পাকিস্তান-বিরোধী অক্ষের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটতে দেরী লাগবে না। চিনের প্রভাব বাড়ারও সম্ভাবনা যথেষ্ঠ।
গত প্রায় দুই দশকে ভারত আফগানিস্তানে সহযোগীর কাজ করে এসেছে কিন্তু আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্যরা দেশটি থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলতে চাইলে সহযোগীর কাজ হারানোর যথেষ্ঠ সম্ভাবনা।