শহরে ট্রাম্প, তবু যেভাবে রণক্ষেত্র হয়ে উঠল দিল্লি
শহরে ট্রাম্প, তবু যেভাবে রণক্ষেত্র হয়ে উঠল দিল্লি
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে শহরের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে একটি ঘিঞ্জি, গরিব মহল্লার নাম সিলমপুর-জাফরাবাদ।
গত শনিবার বিকেলে বেশ কয়েকশো মহিলা আচমকাই সেই জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশনের সামনের রাস্তা আটকে বসে পড়েন। দিল্লির মেট্রো কর্তৃপক্ষ স্টেশনটি বন্ধ করে দিতেও বাধ্য হয়।
তাদের প্রতিবাদ ছিল ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন ও প্রস্তাবিত এনআরসি-র বিরুদ্ধেই - দেশের নানা প্রান্তেই গত দুমাসেরও বেশি সময় ধরে যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে তুমুল আন্দোলন চলছে।
জাফরাবাদে এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন 'ভীম আর্মি' নামে পরিচিত একটি দলিত সংগঠনের নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ।
তার সঙ্গে দিল্লি পুলিশের কার্যত 'লুকোচুরি' চলছে গত বেশ কিছুদিন ধরেই।
জাফরাবাদের নারীরা যখন পথ অবরোধ করেন, তখনও আজাদ নিজে অবশ্য সেখানে ছিলেন না।
এদিকে শনিবার রাতেই দিল্লি পুলিশের একটি দল গিয়ে অবরোধকারীদের উঠে যেতে বলে, তবে তারা সরতে রাজি হননি।
পরদিন এই পথ অবরোধ ছড়িয়ে পড়ে ওই এলাকার আরও নানা প্রান্তে। রবিবার থেকে কাছেই চাঁদ বাগ এলাকাতেও নাগরিকত্ব আইনের বিরোধীরা 'চাক্কা জ্যাম' শুরু করে দেন।
সেদিন বিকেলে তিনটে নাগাদ দিল্লির বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র এই অবরোধের জবাবে 'যারা নাগরিকত্ব আইন সমর্থন করছেন' তাদের দলে দলে এসে মৌজপুর চকে জড়ো হওয়ার জন্য টুইট করেন।
নাগরিকত্ব আইনের সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে পুরোদস্তুর সংঘাত শুরু হয়ে যায় এরপর থেকেই।
রবিবার সন্ধ্যায় কপিল মিশ্র আরও একটি ভিডিও টুইট করেন, যেখানে তাকে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে পুলিশের ডেপুটি কমিশনার বেদ প্রকাশের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
কপিল মিশ্র লেখেন, "আমার সমর্থকরা শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে। এরপর আমরা দিল্লি পুলিশের কথাও শুনব না, জোর করে অবরোধ তুলে দেব।"
জাফরাবাদ ও চাঁদ বাগের পরিস্থিতি 'স্বাভাবিক' করে তোলার জন্য তিনি দিল্লি পুলিশকে তিন দিনের আলটিমেটামও বেঁধে দেন।
কপিল মিশ্র তার উত্তেজক ও সাম্প্রদায়িক কথাবার্তার জন্য বেশ পরিচিত, সম্প্রতি দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনকে 'ভারত বনাম পাকিস্তান' ম্যাচ বলে বর্ণনা করেও তিনি বিতর্কে জড়িয়েছিলেন।
https://twitter.com/KapilMishra_IND/status/1231544492596981760
তবে দিল্লির নির্বাচনে তিনি মডেল টাউন থেকে বিজেপির মনোনয়ন পেলেও নিজের পুরনো দল আম আদমি পার্টির কাছে হেরে যান।
ওদিকে জাফরাবাদ যেমন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধীদের মূল কেন্দ্রে পরিণত হয় - অন্য দিকে মৌজপুর চকে জড়ো হতে থাকে ওই আইনের সমর্থকরা, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন বিজেপি বা তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর কর্মী।
দুটো জায়গার মধ্যে দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটারের।
মৌজপুর এলাকার কাছে বন্দুকধারী ব্যক্তিরা বন্দুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন ভিডিও-ও সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে।
মৌজপুরে চকে রবিবার থেকেই লাউডস্পিকারে চড়া আওয়াজে গান বাজানো হতে থাকে, "যো মাঙ্গে আজাদি দেশ মে, ভেজো পাকিস্তান উনহে!" (যারা এই দেশের ভেতরে আজাদি চাইছে, তাদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দাও)।
এই উত্তেজক আবহ-ই পুরোদস্তুর সংঘর্ষে রূপ নেয় সোমবার বেলা দুটো নাগাদ, যার মাত্র ঘন্টাদুয়েক আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম ভারত সফরে এ দেশে পা রেখেছেন।
একটা পর্যায়ে মৌজপুর চক ও জাফরাবাদ থেকে দুপক্ষই পরস্পরের দিকে ধাওয়া করে যায়। একে অন্যের দিকে তারা পাথর ও ইট-পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করে দেয়।
দিল্লি পুলিশের একটি বাহিনী মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান নিয়ে দুপক্ষকে ঠেকানোর চেষ্টা করেও সফল হয়নি।
মুখোমুখি দুই গোষ্ঠীর সংঘের্ষে যখন পায়ের চাপে পদদলিত হয়ে লোকজনের মারা যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেলও ছুড়তে থাকে।
কয়েকটি অটোরিক্সা ও মোটরবাইকেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, যদিও সেটা কোন পক্ষের কাজ তা স্পষ্ট নয়। ভজনপুরা এলাকায় একটি পেট্রোল পাম্পেও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
গোকুলপুরীর একটি টায়ারের দোকানেও আগুন ধরানো হয়। পুরো এলাকা জুড়ে লুঠপাট, সহিংসতা, বন্দুকধারীদের দাপাদাপিও শুরু হয়ে যায় পুরো দমে।
ততক্ষণে কালো ধোঁয়ার কুন্ডলীতে ছেয়ে গেছে উত্তর-পূর্ব দিল্লির আকাশ।
সোমবার বিকেলের দিকেই জানা যায়, সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে দিল্লি পুলিশের হেড কনস্টেবল রত্তন লাল গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন।
দিল্লি পুলিশের আর এক ডেপুটি কমিশনার অমিত শর্মাও গুরুতরভাবে জখম হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
দিল্লির ওই অঞ্চলে দফায় দফায় সহিংসতা চলেছে রাতভর।
সকালে স্থানীয় গুরু তেগ বাহাদুর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছেন, সংঘর্ষে একজন পুলিশ কর্মকর্তা-সহ মোট সাতজন নিহত হয়েছেন।
তবে নিহতদের সবার পরিচয় এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। পাশাপাশি, সংঘর্ষে আহত শতাধিক ব্যক্তির চিকিৎসাও চলছে বিভিন্ন হাসপাতালে।
বিবিসি হিন্দির সংবাদদাতা ফয়সল মোহম্মদ আলি এদিন সকালেও ওই অঞ্চলে গিয়ে দেখেছেন, পরিস্থিতি ভীষণ থমথমে হয়ে রয়েছে।
জনতা তাদের গাড়ি লক্ষ্য করেও পাথর ছুঁড়তে শুরু করলে তারা একটা পর্যায়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন।
তিনি জানাচ্ছেন, "আমরা যখন এলাকায় শ্যুট করছি, কিছু লোক আচমকা ছুটে এসে আমাদের লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়তে থাকে। ওরা জয় শ্রীরাম স্লোগানও দিচ্ছিল। তাদের হাতে ছিল গেরুয়া ঝান্ডা।"
"গাড়িতেও যখন বেশ কয়েকটা পাথর এসে লাগে, তখন আমরা আর ওখানে থাকার ঝুঁকি নিইনি", বলছিলেন ফয়সল মোহম্মদ আলি।
দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে ট্রাম্পের আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে।