করোনাভাইরাস: কোয়ারেন্টিনের কঠিন কালে কানাডার বাঙালি
কোয়ারেন্টিনের শুরুতে টরোন্টোর বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি গ্রোসারিগুলোতে উপচে পড়া ভিড় আর সবার আগে চাল, ডাল, ময়দার সংকট।
পৃথিবীর বাকি সবাই ভাবতে পারে কানাডার মানুষগুলো হয়তো সারা বছর নিচে আটকে থাকে। বছরের বেশিরভাগ সময় বরফের স্তুপ দেখতে হয় বটে, তবে কানাডার মানুষকে তার নিচে আটকে রাখা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তারা বরফ নিয়ে খেলার দশটা বুদ্ধি বের করে ফেলবে!
সেই মানুষগুলোকে যখন ঘরে থাকতে বলা হলো তাও বসন্তের দিনগুলোতে, এর চেয়ে কঠিন আর কি হতে পারে। স্বভাবগতভাবে নম্র, ভদ্র কানাডার সমাজকে ঘরে আটকাতে সরকারকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। বাঙালি সমাজকে তো আরো নয়।
কানাডার বাঙালি সমাজ মূলত টরোন্টো ও তার পার্শ্ববর্তী শহরগুলো ঘিরে। এদের জীবনধারা মূলত দাওয়াত কেন্দ্রিক। মূলধারার সমাজের সাথে মিশতে না পারা, অথবা এখানকার সাধারণ জীবন যাপনের সাথে মানিয়ে নিতে পারা, যেকোনো কারণেই হোক, এরা দেশীয় মানুষদের বন্ধনে নিজেকে আরো বেশি আবদ্ধ করে ফেলে।
কোয়ারেন্টিনের শুরুতে তারই প্রতিফলন দেখা গেল বিকট আকারে। বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি গ্রোসারিগুলোতে উপচে পড়া ভিড় আর সবার আগে চাল, ডাল, ময়দার সংকট ছিল তারই লক্ষণ।
তবে বলাই বাহুল্য, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থাকায় বাঙালি গ্রোসারি থেকেই অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
পাশাপাশি যখন মূলধারার বেশিরভাগ সুপারস্টোর হোম ডেলিভারির সুবিধা দিয়ে থাকে, দেশীয়গুলোর মধ্যে মাত্র একটিই তা করে থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিদের গ্রোসারি করতে বাড়ির বাইরে নিয়মিত যেতেই হয়।
বাঙালি রেস্টুরেন্টের হোম ডেলিভারি
উবার ইটসের জনপ্রিয়তার পাশাপাশি এই সময় কিছু দেশীয় রেস্টুরেন্ট হোম ডেলিভারি দেয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তারই একটি চকবাজার। এর স্বত্বাধিকারী তানজিল ফেরদৌস জানান কোয়ারেন্টিনের সময়ে তাদের সাপ্তাহিক খাবারের চাহিদা অনেক বেড়েছে।
"মূলত শিক্ষার্থী, তরুণ পেশাজীবীরাই আমাদের সাপ্তাহিক খাবারের অর্ডার দিয়ে থাকতেন। কিন্তু এখন সর্বস্তরের মানুষই তা করছেন,'' তিনি বলেন।
''গ্রোসারি করতে যাওয়ার চেয়ে সুলভ মূল্যে তৈরি খাবার ঘরের দোরগোড়ায় চলে আসা অনেকের জন্যই সুবিধাজনক। এদিকে রমজানে ইফতারির চাহিদাও বেড়েছে। শুধু বাঙালি নয়, অন্যান্য জাতির মুসলিমরাও আমাদের কাছ থেকে ইফতারির অর্ডার করছেন," বলেন তানজিল ফেরদৌস।
লকডাউনের পর থেকে মূলধারার রেস্টুরেন্ট সহ বেশকিছু দেশীয় রেস্টুরেন্টও বন্ধ হয়ে যায়। তবে রমজানে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এবং সরকারের আর্থিক সহযোগিতা থাকায় অনেকেই তা পুনরায় চালু করেন।
গোপনে দাওয়াত
ভোজনবিলাসী বাঙালির দাওয়াত কমে গেলেও রান্না আর তার ছবি ফেসবুকে দেয়া বেড়ে গিয়েছে- এ নিয়ে বাঙালিদের গ্রুপও খোলা হয়েছে। তাতে চলছে রান্নাকরা খাবারের ছবি আর রেসিপি শেয়ার।
দাওয়াত কমে গিয়েছে বলার কারণ- এখনও তা চলেছে, তবে খানিকটা গোপনে। এদিকে ব্র্যাম্পটনে এক বাড়িতে প্রতিবেশীর অভিযোগের ভিত্তিতে জন প্রতি পাঁচ হাজার কানাডীয় ডলার জরিমানা করা হয়।
আশা করা যায় এর প্রভাবে কিছুটা হলেও মানুষ আগের থেকে বেশি সাবধান হয়েছে।
জীবন এখন অনেকটাই অনলাইন, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম নির্ভর। মূলধারার সমাজ লিঙ্কড-ইনে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান-ভিত্তিক ওয়েবিনার করে যাচ্ছে। এমনকি অনেক পেশাজীবীই এগিয়ে এসেছেন তাদের বেঁচে যাওয়া সময়টুকুতে তাদের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরে অন্যদের সমৃদ্ধ করতে।
বাঙালি সমাজে এমনিতেই লিঙ্কড-ইনের ব্যাবহার কম, পডকাস্ট নেই বললেই চলে। তারপরও নিজের সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে আনন্দ ছড়িয়ে যে মানুষের জীবনে কিছুটা স্বস্তির বাতাস বইয়ে দেয়া যায়, তার উদাহরণ প্রথম তৈরি করেন ফটোগ্রাফার রাজীব হাসান চৌধুরী।
লাইভে এসে গান
একটি গিটার হাতে নিয়ে বসে পড়েন তার নিজের ফেসবুকে। তার লাইভ গানের মূর্ছনা সুর তোলে বিভিন্ন বাঙালিদের গ্রুপে। এ নিয়ে রাজীব হাসান চৌধুরীর সাথে কথা হয়।
"এই সময়টা আসলে আমাদের অনেকেরই সুপ্ত প্রতিভাকে বের করে আনতে সাহায্য করছে। যা হয়ত ব্যস্ততার কারণে অন্য সময় আমরা করিনি, তা এখন করছি,'' তিনি বলেন, ''পাশাপাশি নিজের অনেক বোধোদয় হতেও সাহায্য করছে।"
এখন বিভিন্ন গ্রুপে প্রায় নিয়মিতই কেউ না কেউ লাইভে এসে গান করছে। যা অনেক গুণী শিল্পীদের যেমন সমাজের সামনে নিয়ে আসছে, মানুষকে ভালো সময় উপহার দিয়েছে, তেমনি কিছু কিছু অতি উৎসাহী মানুষের গান যথেষ্ট বিরক্তিরও উদ্রেক করেছে।
চাকরির বাজার পড়ে যাওয়ার, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে সরকারের সাহায্য ঘোষণা এক বিশাল স্বস্তি নিয়ে এসেছে। মূলত এরাই প্রকৃত অর্থে আক্রান্ত।
তবে এখানে অন্যান্য আয়ের সুযোগ থাকার পরও বা কানাডায় অবস্থান না করেও অনেকে সরকারি সাহায্যের আবেদন করেছেন। যেহেতু এই মুহূর্তে ব্যাকগ্রাউন্ড চেক হচ্ছেনা, তাই খুব বেশি আশংকায় তেমন কেউ নেই।
নিউইয়র্ক নিয়ে উদ্বিগ্ন
তবে কিছুটা বিপাকে পড়েছেন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ইন্টারন্যাশনাল ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছেন গুটিকয়েক সহৃদয় ব্যক্তি। তারা পৌঁছে দিয়েছেন মাসের বাজার। সহায়তা করছেন দেশ থেকে তাদের হাতখরচ পেতেও। বর্তমানে তারা ইফতারিও পৌঁছে দিয়েছেন।
করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর হার বাঙালি কমিউনিটিতে কম হলেও, আতঙ্ক বিরাজ করছে কমবেশি সবার মধ্যেই। বর্ডারের ওপারেই নিউইয়র্ক সহ গোটা আমেরিকার অবস্থাই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে বেশি।
অনেকেরই আবার আমেরিকায় আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব রয়েছে। আবার অনেক বাংলাদেশি-কানাডিয়ানও আমেরিকায় কর্মসূত্রে রয়েছে। তাদের নিয়ে এখানকার কাছের মানুষদের দুশ্চিন্তাও কম নয়।
তারপরও এ সবকিছুর মধ্য থেকেই ভালো থাকার চেষ্টা করেছে সবাই। প্রত্যাশা এক সুন্দর, সু'আগামীর।