চিন লড়ছে কোভিড–১৯–এর সঙ্গে, মহামারি রুখতে মরিয়া দক্ষিণ কোরিয়া
বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের এখন একটাই নাম করোনা ভাইরাস। হু–এর মহামারি তকমা দেওয়া এই সংক্রমকে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত চিন। প্রত্যেকদিনই এই দেশে নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে এই রোগে। কিছু সপ্তাহ আগেই হাজার জনেরও বেশি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।
১২ মার্চ চিনে নতুন করে ৮ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে। প্রত্যেকদিনই এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। চিনের যে শহর থেকে এই মহামারি রোগের সূত্রপাত হয়েছিল সেখানেও ৫টি নতুন আক্রান্তের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। তবে টানা দ্বিতীয় দিন ১০–এর চেয়ে কম সংখ্যায় আক্রান্ত হয়েছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে কোনও সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি। চিনের অর্থনৈতিক হাব হিসাবে পরিচিত সাংঘাইয়ে নতুন করে দু’জনের শরীরে ও বেজিংয়ে একটি সংক্রমণের খবর পাওয়া গিয়েছে। দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মতে, চিনের বাইরে প্রভাবিত দেশগুলিতে চিনাবাসীর ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যা চিনেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানিয়েছে যে এই দেশে জানুয়ারির শেষে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছে।
করোনা ভাইরাস থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে চিন বেশ কিছু সামাজিক দুরত্ব কার্যকর করেছে। যার মধ্যে প্রথম হল, ২৩ জানুয়ারি থেকে ৯৩০ মিলিয়ন চিনের বাসিন্দাদের আক্রান্ত এলাকাগুলিতে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, চিনের অধিকাংশ শহরই মৃত্যুপুরিতে রূপান্তরিত এবং শত শত মানুষ নিজেদেরকে একসপ্তাহের জন্য গৃহবন্দী করে রেখেছে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয়দের ভ্রমণ ও ফুড ডেলিভারির ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি, গাড়িগুলির স্ক্রিনিং করা ও শহরের স্থানীয় দোকানপাটও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা থাকছে। তৃতীয়ত, চিনের উহান শহর থেকেই এই মহামারি রোগের সূত্রপাত। এই ভাইরাস যাতে আর না ছড়ায় তার জন্য বহু বিশেষজ্ঞদের ওই শহরে পাঠানো হয়েছে। চতুর্থত, সকলের থেকে ১.৫ মিটার দুরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা এবং আবাসিক স্থান ও দপ্তরে সকলের ভ্রমণের ইতিহাস নথিভুক্ত করা। পঞ্চমত, প্রত্যেক পরিবারে একজন করেই চিনের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। ষষ্ঠত, সব স্কুল বন্ধ ও অনলাইনে পঠন–পাঠন শুরু।
হু–এর ডিরেক্টর জেনারেল জানিয়েছেন যে হাজার হাজার সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে চিনের সমন্বিত ও বিস্তৃত পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ।
চিনের সরকারকে সবধরনের সাহায্য করছে টেলিকম পরিষেবাগুলি। তারা ট্র্যাক করে দেখছে চিনের বাইরে থেকে কোন কোন বিদেশি ঢুকেছে এবং মানুষের যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। এই পদ্ধতির নাম হেল্থ কোড নির্ধারণ। এটি হল কোনও ব্যক্তির সফরের ইতিহাসের ওপর তিনটে রংয়ের কোড নির্ধারণ হবে। চেকিং পয়েন্টে বসানো হয়েছে সবুজ, হলুদ ও লাল স্ট্যাটাস।
এর পাশাপাশি বেশ কিছু চিনের সংস্থা মুখ দেখে চেনার পদ্ধতি প্রয়োগ করতে শুরু করে দিয়েছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে বোঝা যাবে যে কোনও ব্যক্তির জ্বর হয়েছে কিনা বা মাস্ক কেউ পরেছে কিনা। চিনের সরকারের নির্দেশগুলি কোউ কোনওভাবে লঙ্ঘন করলে তাকে শাস্তিও পেতে হতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও নেটিজেনরা কেউ আক্রান্ত হয়েছে কিনা বা সরকারের নিয়ম ভঙ্গ করছে কিনা তা জানাতে পারে। কিছু কিছু শহরে বাসিন্দারা নিয়ম ভঙ্গের খবরের জন্য পুরস্কৃত হচ্ছেন।
করোনা ভাইরাস নিয়ে চিনের প্রতিক্রিয়া হু–এর প্রশংসা পেলেও, চিন সরকারের অব্যবস্থা প্রাথমিক পর্যায়েই নজরে এসেছিল। উহানে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয় ৮ ডিসেম্বর, কিন্তু ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত চিন সরকার কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। ৩৪ বছরের চিকিৎসক ডাঃ লি ওয়েনলিয়াং অনেক আগে থেকেই চেষ্টা করছিল এটা বলার যে এটি সার্সের মতো ভয়ানক সংক্রমক। কিন্তু তিনি গুজব ছড়াচ্ছেন বলে তাঁকে শাস্তি পেতে হয় এবং তাঁর মুখ বন্ধ করে দেয় চিন সরকার। কিছুদিনের মধ্যেই লি অন্যকে সাহায্য করতে গিয়ে মারা যান।
চিনের বাইরে তৃতীয় নম্বরে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। এখানে সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যা হলেও দ্রুত সেরে ওঠার খবরও সপাওয়া যাচ্ছে। জানুয়ারিতেই এই দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়। চিনের মতোই দক্ষিণ কোরিয়াতেও প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিন্তু এই দেশটি প্রথম থেকেই সংক্রমণ রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে ময়দানে নেমে যায়। এই দেশের সরকার টেলিফোন পরামর্শদাতা, প্রচুর টেস্ট সেন্টার ও তাপমাত্রা মাপার ক্যামেরা বসায় দেশজুড়ে। প্রত্যেকদিন ২০ হাজার করে পরীক্ষা হত ৬ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। যাদের শরীরে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিত তাঁদের বিনামূল্য কিট দেওয়া হত। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন চার্চের যাজকরাও আক্রান্তদের সুস্থ হতে সাহায্য করেছে।