ব্রিটেনের নির্বাচন: বিজয়ী বরিস জনসন কী ব্রেক্সিট প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন?
যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ডাউনিং স্ট্রিটে ফিরে এসেছেন বরিস জনসন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসার চূড়ান্ত কাজটি তাকে করতে হবে। কিন্তু কীভাবে তিনি এই পর্যন্ত এলেন?
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আবার ডাউনিং স্ট্রিটে ফিরে এসেছেন বরিস জনসন।
টেরেসা মেকে সরিয়ে যখন তিনি গত জুলাই মাসে প্রথমবার কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হিসাবে ডাউনিং স্ট্রিটে আসেন, তখন সমালোচকরা বলেছিলেন যে, দলের মাত্র ১ লাখ ৬০ হাজার সদস্য তাকে এই দায়িত্বের জন্য নির্বাচিত করেছে।
এখন বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে ভোটাররাও তাঁর প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে।
বিভক্ত মতামত এবং মনোযোগ আকৃষ্টকারী বিতর্কের মধ্য দিয়ে নিজের পেশা জীবন গড়েছেন জনসন- প্রথমে একজন সাংবাদিক হিসাবে, পরে রাজনীতিবিদ।
কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হওয়ার তার অনেক সমালোচক মনে করেছিলেন যে, ক্ষমতায় টিকে থাকার মতো যথেষ্ট দক্ষতা তার নেই।
কিন্তু তাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করেছেন জনসন।
কীভাবে তিনি এই পর্যন্ত এলেন?
তুরস্কের পূর্বপুরুষ এবং ব্রাসেলসের জীবন
বরিস জনসন নিজেকে ইউরোপের একজন সমালোচক হিসাবে বর্ণনা করেন- ইউরোস্কেপটিক। কিন্তু তাকে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে নাকচ করাও কঠিন।
তুরস্কের একজন সাংবাদিকের প্রপৌত্র বরিস জনসনের জন্ম হয় নিউইয়র্কে।
পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে ফিরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাসের আগে কূটনীতিক পিতা এবং শিল্পী মার সঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে, যুক্তরাজ্যে এবং ব্রাসেলসে বসবাস করেন।
আরো পড়ুন:
যুক্তরাজ্য নির্বাচন: ইসলাম ও ইহুদি বিদ্বেষ যখন ইস্যু
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বান্ধবীকে নিয়ে বিতর্কের ঝড়
ব্রিটিশ রাজনীতি: আদালতে কেন হারলেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন
বরিস জনসন: ব্রিটেনের বিতর্কিত নতুন প্রধানমন্ত্রী
অভিজাত বোর্ডিং স্কুল ইটনে পাঠানো হয় তাকে, যেখানে তার অদ্ভুত স্বভাব বা ভিন্নকেন্দ্রী ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে, যেজন্য তিনি বিশেষ পরিচিত।
পরবর্তীতে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসিক নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং অক্সফোর্ড ইউনিয়ন ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
সাংবাদিক হিসাবে কাজ করার সময় থেকেই বিতর্ক তৈরির প্রতি জনসনের আগ্রহের ব্যাপারটি পরিষ্কার হতে শুরু করে। টাইমস পত্রিকা থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়, কারণ তিনি একটি উদ্ধৃতি নিজে থেকে বানিয়ে দিয়েছিলেন।
এরপরে তিনি রক্ষণশীল ঘরানার পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফের ব্রাসেলস সংবাদদাতা হিসাবে কাজ শুরু করেন।
''তার সাংবাদিকতায় তথ্য উপাত্তের সঙ্গে ইউরোপের বুনো কল্পিত সমালোচনাও দক্ষতার সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হতো'', বলছেন বিবিসির রাজনৈতিক বিভাগের উপ-সম্পাদক জন পিয়েনার।
বরিস জনসনের একটি সংবাদের শিরোনামে দাবি করা হয়েছিল যে, ব্রাসেলস এমন পেশাদার লোকজনকে নিয়োগ করেছে, যাদের কাজ হবে ইউরোপের সবকিছু যাতে একই রকম হয়, সেটা নিশ্চিত করা।
''সেখানে অবৈধভাবে বাঁকানো কলা, ভুল আকারের কনডম সম্পর্কিত গল্পগাঁথা ছিল,'' বলছেন মি. পিয়েনার।
সেসব লেখার ভেতরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি তার ক্ষুব্ধতার ব্যাপারটি নিহিত ছিল, যা তার পরবর্তী জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
তবে তখন অনেক সহকর্মী তরুণ ওই প্রতিবেদকের আচরণকে 'বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অসততা' বলে বিবেচনা করতেন, বলছেন সাংবাদিক ডেভিড আসবর্ন, যিনি বর্তমানে দি ইন্ডিপেনডেন্ট অনলাইন পত্রিকার যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ক সম্পাদক।
জ্বালাময়ী কলাম লেখক
যুক্তরাজ্যে ফিরে এসে বরিস জনসন টেলিগ্রাফ পত্রিকায় কলাম লিখতে শুরু করেন এবং পরবর্তীতে ডানপন্থী পত্রিকা স্পেক্টেটরের সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
মি. জনসনের লেখায় বিশেষ কিছু পাঠককে আহত করার প্রবণতা দেখা যায়, যেখানে তিনি আফ্রিকান জনগোষ্ঠী এবং একক মায়ের সন্তানদের ক্ষেত্রে 'ঠিকভাবে বড় না করা, অজ্ঞ, আগ্রাসী এবং অবৈধ'' ইত্যাদি নানা মানহানিকর শব্দের ব্যবহার করেন।
তবে তিনি স্পেক্টেটরের প্রচার সংখ্যা বাড়াতে সক্ষম হন।
বিবিসির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান 'হ্যাভ আই গট নিউজ ফর ইউ?' অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে নিয়মিত উপস্থিত হওয়ার পর থেকে তার মিডিয়া প্রোফাইলও বড় হতে থাকে। ওই অনুষ্ঠানে আসা অতিথিরা সপ্তাহের সংবাদগুলো নিয়ে মজার রসিকতা করে থাকেন।
তার জীবনীকার সোনিয়া পার্নেলসহ অনেক ভাষ্যকারের মতে, শব্দের ব্যবহার এবং মতামতের কারণে তিনি সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু হলেও, একই সঙ্গে সেসব তাকে রাজনৈতিক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বেও পরিণত করেছে।
যা রাজনীতিতে তাঁর আত্মপ্রকাশের মঞ্চ তৈরি করেছিল।
কেবলমাত্র বরিস
২০০১ সালে বরিস জনসন অক্সফোর্ডের নিকটবর্তী রক্ষণশীল সমর্থক জেলা হিনলি-অন-টেমস থেকে এমপি নির্বাচিত হন।
২০০৭ সালে লন্ডনের মেয়র হিসাবে নির্বাচিত হওয়া তাকে বিশ্ববাসীর কাছেও পরিচিত করে তোলে।
২০১২ সালের অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় যখন বিশ্ববাসীর নজর এই শহরের দিকে, তখন জনসন অনেকটা ওই আসরের দূতের মতো হয়ে ওঠেন, যদিও অলিম্পিকের আসরটি শহর কর্তৃপক্ষ সিটি হল আয়োজন করেনি।
তার বিখ্যাত পরিবহন কর্মসূচীগুলোর একটি হলো ২০১০ সালের জুলাই মাসে চালু করা তথাকথিত 'বরিস বাইক'সাইকেল কর্মসূচী। এটা হচ্ছে একজন রাজনীতিবিদ এবং খ্যাতিমান ব্যক্তি হিসাবে তাঁর মিশ্র অবস্থানের একটি প্রমাণ, যে তিনি সবসময়েই শুধুমাত্র 'বরিস হিসাবে পরিচিত ছিলেন।
নিজে ব্যবহার করার মাধ্যমে ভাড়ার সাইকেল ব্যবহার করতে নিয়মিতভাবে প্রচারণা চালাতেন বরিস জনসন। একবার তিনি হলিউডের তারকা অভিনেতা আর্নল্ড শোয়ার্জনিগারের সঙ্গেও এ নিয়ে প্রচারণা করেছেন।
তবে সমালোচকরা বলেন, এটা এমনকি তার আইডিয়া ছিল না- তাঁর আগের মেয়র এই কর্মসূচীটি চালু করেছিলেন।
সমালোচনার মধ্যেও পড়েছেন মি. জনসন।
প্রিন্সেস ডায়ানার স্মরণে লন্ডনের নদী টেমসের ওপর একটি বাগান ব্রিজ বানানোর তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা পরবর্তী মেয়র সাদেক খান বাতিল করে দেন। কিন্তু তার আগেই ওই পরিকল্পনার পেছনে প্রায় ৭০ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করা হয়ে গেছে।
ব্রেক্সিট চ্যাম্পিয়ন
২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে একটি আসনে জিতে পার্লামেন্টে আবার ফিরে আসেন বরিস জনসন।
২০১৬ সালের ব্রেক্সিট গণভোটের আগেভাগে ওই ব্যাপারে জনসনের অবস্থান খুব বেশি পরিষ্কার ছিল না।
তিনি একটি সংবাদপত্র নিবন্ধে যুক্তি তুলে ধরেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়া উচিত এবং আরেকটি খসড়া প্রস্তুত করে রেখেছিলেন যেখানে বলা হয়েছে যে, যুক্তরাজ্যের ইউনিয়নে থাকা উচিত।
তবে শেষপর্যন্ত তিনি ইউরোপ ছাড়ার পক্ষে অবস্থান নেন এবং তাঁর অর্থ হলো দলের তৎকালীন নেতা ও প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া।
নির্বাচনে ইউরোপ ছাড়ার পক্ষে ভোট পড়ে এবং ক্যামেরন পদত্যাগ করেন, তখন কনজারভেটিভ দলের নেতা হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার একটা চেষ্টা করেন জনসন।
কিন্তু টেরেসা মে বিজয়ী হিসাবে আবির্ভূত হন- ভোটাভুটির আগেই অন্য সকল প্রার্থীদের সরে যেতে হয়। কিন্তু ব্রেক্সিট চ্যাম্পিয়ন হিসাবে জনসনের ভূমিকার স্বীকৃতি দিতে তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়।
গণভোটের প্রচারণার সময় জনসনের নাম সন্দেহজনক একটি দাবির সঙ্গে জড়িয়ে যায় যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়া হলে যুক্তরাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিভাগে প্রতি সপ্তাহে ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড যোগ করা যাবে।
তবে এটি ব্রেক্সিট সমর্থকদের মধ্যে তার অবস্থানের ক্ষতি করতে পারেনি।
মি. জনসন পরবর্তীতে টেরেসা মে'র মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসেন এই দাবি করে যে, ব্রাসেলসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সময় তাঁর (টেরেসা মে) আরো কঠোর ভূমিকায় থাকা উচিত।
দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর-এবং প্রধানমন্ত্রী- বরিস জনসন কখনোই চুক্তি ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনাকে নাকচ করেন নি।
তিনি বলেছেন, সাধারণ নির্বাচনে যদি কনজারভেটিভ পার্টি বিজয়ী হয়, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্য ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারির মধ্যেই বেরিয়ে আসবে।
ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনে জোরালো মতামত এবং মানুষকে আকৃষ্ট করার মতো ক্ষমতা ভোটারদের হৃদয় জয় করতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
আর নিজের পুরো জীবন জুড়ে এই দুইটি ক্ষেত্রেই অনন্য সাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন বরিস জনসন। ।