নারীদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রংপুরের বীথি
ঢাকা ফার্স্ট ডিভিশন ম্যাচ চলাকালীন সময়ে হঠাৎ নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে বীথির। ডাক্তার সব পরীক্ষা করে বলেন নাকে ইনফেকশন হয়েছে। এরপরেও খেলা চালিয়ে গেলে বড় ক্ষতি হতে পারে ফলে ক্রিকেট ছেড়ে দিতে হয়।
রংপুরের মেয়ে আরিফা জাহান বীথি, নিজের শহরেই দেশের এক মাত্র নারী ক্রিকেট একাডেমিটি চালাচ্ছেন।
তার একক চেষ্টায় গড়ে তোলা এই " ওমেন ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমিতে" এখন দুইশ পঞ্চাশ জনের বেশি মেয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। বীথির স্বপ্ন এখান থেকে জাতীয় দলের জন্য খেলোয়াড় তৈরি করবেন।
অথচ এক সময় নিজের সব স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিলো বলে আত্মহত্যাও করতে চেয়েছিলেন তিনি।
২০১০ সালে পেশাদার লীগ খেলা শুরু করেন বীথি। ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ, ওরিয়েন্ট স্পোর্টিং ক্লাব, ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট একাডেমিতে ফার্স্ট ডিভিশন খেলেছেন বীথি। কিন্তু ২০১৭ সালে হঠাৎ করেই ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়।
ঢাকা ফার্স্ট ডিভিশনের এক ম্যাচ চলাকালীন সময়ে নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে বীথির। ডাক্তার সব পরীক্ষা করে বলেন নাকে ইনফেকশন হয়েছে। এরপরেও খেলা চালিয়ে গেলে বড় ক্ষতি হতে পারে, ফলে ক্রিকেট ছেড়ে দিতে হয়।
ক্রিকেট ছেড়ে বিমর্ষ বীথিকে বিয়ের জন্য রাজি করান তার পরিবারের লোকজন, কিন্তু সে বিয়েও শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায়।
"বিয়ের সব আয়োজন করা হয় যে- ছেলেরা আসবে, বিয়ের দিন তারা ফোন দিয়ে বলে যে মাঝ রাস্তা পর্যন্ত এসেছে। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত আসেনি এবং বিয়েটা বাতিল হয়ে যায়, কারণ আমি দেখতে কালো কালো এবং আমি একটু মোটা।"
অথচ দেখে শুনে বীথিকে পছন্দ করেই বিয়ের আয়োজন করেছিলো বর পক্ষ। পরে জানা যায় বীথির পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় বিয়ে ভেঙে যায়।
" আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার ভালো না, আমি আইন বিষয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। টাকার অভাবে সেটাও হয়নি। তারপর পরিবারের কথায় আমি রাজি হলাম যে বিয়ে করবো। সেটাও যখন হয়নি তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই, আমি আত্মহত্যা করবো। এক পর্যায়ে আমার পরিবার সেটা জানতে পারে এবং আমাকে সেখান থেকে বের করে আনে। তারপরে আমি তাদেরকে জানাই যে আমি ক্রিকেট একাডেমি দিবো।" বলেন বীথি।
বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:
নারী ক্রিকেটারদের বেতন বৈষম্য: পরিবর্তন আসবে?
বাংলাদেশ ও ভারতের নারী ক্রিকেটের তারতম্য কতটা?
১০০ বলের ক্রিকেট নিয়ে যা জানার আছে
শুরুতে তিরিশ জন ছাত্রী নিয়ে শুরু হয় বীথির " ওমেন ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি"। বর্তমানে এখানে আড়াইশোর বেশি ছাত্রী আছে। তবে এখানে যারা খেলতে আসে তাদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। মূলত ভালো খেলে বিভাগীয় পর্যায়ে সুযোগ পেলে মেয়েরা কিছু অর্থ আয় করতে পারবে, পরিবারে স্বচ্ছলতা আসবে এই আসায় দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা এখানে খেলতে আসে।
নিজেকে ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তোলার কোন স্বপ্ন ছিল না বীথির, স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ক্রিকেটে ভালো করায় জেলা পর্যায়ে খেলার সুযোগ পান তিনি। পরে ধাপে ধাপে ফার্স্ট ডিভিশন পর্যন্ত খেলেন। মূলত পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতেই পেশাদার ক্রিকেটে আগ্রহী হন তিনি।
বাবা মায়ের চার সন্তানের মধ্যে চতুর্থ বীথি, আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে বাবার সাথে দোকানে কাজ করতে হতো। এখনো অনলাইনে কাজ করে এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রে লেখালিখি করে যে আয় করেন, এবং তা দিয়ে একডেমির খরচ বহন করছেন। ইনজুরির কারণে মাঠের ক্রিকেট থেকে বিদায় নিলেও মাঠ থেকে বিদায় নিতে চাননি বীথি।
"আমাকে ক্রিকেট ছাড়া থাকতে হবে এটা আমি কখনোই মানতে পারিনি। যখন আমার মাথায় আসে মেয়েদের তো ক্রিকেট একাডেমি নেই বাংলাদেশে। আমি কেন এটা শুরু করি না? এবং আমি চেষ্টা করেছি যে আমি কোন কোন সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছিলাম। এই সমস্যাগুলো যেন অন্য নারী ক্রিকেটাররা মুখোমুখি না হয়, এই জন্যই আমি আবার ক্রিকেটে ফিরি এবং কোচিংয়ে মন দিই।"
তবে নারীদের ক্রিকেট একাডেমি চালাতে গিয়ে সামাজিক নানান বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। নিজে ক্রিকেট খেলার চেয়ে ক্রিকেট একাডেমি চালানো বেশি চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন বীথি।
" অনেকে বলে মুরগি দিয়ে হালচাষ করি, বলে যে- মেয়ে হয়ে ট্রাউজার, টি-শার্ট এসব পোশাক কেন পরছো? এগুলো আসলে কীভাবে সামলাবো? এসব সামলানো কষ্ট হয়ে যায় আমাদের জন্য।"
এসব কথা শুনে অনেক পরিবার তাদের মেয়েদের অনুশীলনে আসতে দিতে চান না, তখন বীথিকে দায়িত্ব নিতে হয় তাদের পরিবারকে বোঝানোর এবং মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়েও বেশি জোর দিতে হয়।
বর্তমানে রংপুর স্টেডিয়ামে বীথির একাডেমির মেয়েরা অনুশীলন করে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে অন্তত এই একাডেমির পাঁচজন মেয়ে জাতীয় পর্যায়ে খেলতে পারে সে লক্ষ্যে কাজ করছে " ওমেন ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি" ।