বাংলাদেশে ৭৫ ও ৮১ সালের মতো অভ্যুত্থানের ঝুঁকি কমেছে: সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল হারুন
বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. হারুন-অর-রশীদ বলছেন, ১৯৭৫ কিম্বা ১৯৮১ সালের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি অনেক কমে গেছে।
বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. হারুন-অর-রশীদ বলছেন, ১৯৭৫ কিম্বা ১৯৮১ সালের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি অনেক কমে গেছে।
তিনি বলেন, এই দুটো হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীতে বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে। এই বাহিনী এখন আগের চাইতেও অনেক বেশি সুসজ্জিত ও সুশিক্ষিত। বাহিনীর সৈনিক থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের অফিসারদের প্রশিক্ষণের সময় তাদের বোঝানো হয় জাতির উন্নতির জন্যে গণতন্ত্রের কোন বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশে এখন যে রাজনীতি তার প্রভাব প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানেই আছে। "সেনাবাহিনীতেও সেটা আছে। আমি অস্বীকার করতে পারবো না।"
"সেনাবাহিনীতে এখন যে ব্যবস্থা আছে সেখানে আইনের প্রয়োগ বেশি। আগে যেমন উপর থেকে অনেক কিছু চাপিয়ে দেওয়া হতো সেটা অনেকাংশে কমে গেছে।
সৈনিক থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে জাতীয়তা, জাতীয় মূল্যবোধ এবং জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। এবং সেনাবাহিনীর কি ধরনের ভূমিকা নেওয়া উচিত সেসব নিয়েও আলোচনা হয়।"
জেনারেল হারুন-অর-রশীদ ২০০০-২০০২ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। আর ১৯৭৫ সালে ছিলেন একজন মেজর।
১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা থেকে শুরু করে ৭ই নভেম্বর সময়কাল ছিল বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর জন্য একটি ক্রান্তিকাল।
সেসময় মধ্য-সারির কিছু সেনা কর্মকর্তা চেইন অব কমান্ডের তোয়াক্কা না করে একের পর এক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান করেছে। নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সিনিয়র কমান্ডাররা জুনিয়রদের কাছে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, বন্দী হয়েছেন। বলা হয়, ঐ কয়েক সপ্তাহে সেনাবাহিনীর চেইন অব কম্যান্ড পুরোপুরি ধসে পড়েছিল।
বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল হারুন বলেন, এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই ছিলো এই বাহিনীর জন্যে বড়ো ধরনের চ্যালেঞ্জ।
তার মতে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো সৈন্যদেরকে কিভাবে আবার ব্যারাকে ফিরিয়ে আনা যায় এবং চেইন অফ কমান্ড পুনরুদ্ধার করা যায়।
"তখন সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন গ্রুপিং ছিলো। একটা গ্রুপ ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের। আরেকটি গ্রুপ ছিলো পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা সৈন্যদের। তাদের মধ্যে একটা অসন্তোষ ছিলো যে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশি সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এর সাথে ছিলো রাজনীতি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ তখন এই গ্রুপিংকে কাজে লাগিয়েছে," বলেন তিনি।
জেনারেল হারুন বলেন, এই বিশৃঙ্খল অবস্থার পর চ্যালেঞ্জ ছিলো যারা এসবের সাথে জড়িত ছিলো তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। তারপর তাদেরকে শাস্তি দিয়ে একটা উদাহরণ সৃষ্টি করা।
এরই অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের পর সামরিক বাহিনীতে বহু বিচার হয়েছে। প্রথম দিকে বেশ কয়েকজন অফিসার ও সৈনিককে ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। অনেককে চাকরি থেকেও বরখাস্ত করা হয়েছে।
কিন্তু এর মাত্র ছয় বছর পর আবারও সেনাবাহিনীর ভেতরে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। ১৯৮১ সালে আরেক অভ্যুত্থানে হত্যা করা হয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে। কেন?
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল হারুন বলেন, "উপরে উপরে কাজ হয়েছে। কিন্তু যেসব কারণে এসব অভ্যুত্থান ঘটেছিলো সেদিকে কেউ নজর দেয়নি। অফিসারদের শাস্তি দেওয়া হলো কিন্তু সেনাবাহিনীর মনোভাবে পরিবর্তনের জন্যে কেউ কাজ করেনি।"
তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণেই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছেন।
তার হিসেবে জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতা থেকে হটাতে ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ১৯টি অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছিলো এবং ২০তম অভ্যুত্থানেই জেনারেল জিয়া নিহত হয়েছিলেন।
সেসময় সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণ সম্পর্কে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, "সেনাবাহিনীর রাজনীতিকরণ হয়েছে। সেনাবাহিনীর ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের ধারাকে অবদমিত করে মৌলবাদী ধারাকে তখন প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালানো হয়েছিলো। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বড় রকমের অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিলো। তারই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ক্যু হয়েছে।"
তিনি বলেন, জেনারেল এরশাদের শাসনামলেও এই একই ধারা অব্যাহত ছিলো।
জেনারেল হারুনের মতে, "সেনাবাহিনীর চরিত্র বদলানোর জন্যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে সকল স্তরে মটিভেশনাল সিস্টেম চালু ছিলো। সকল ক্ষেত্রে ইসলামের কথা বলে সেনাবাহিনীতে মৌলবাদের এই ধারা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।"
"যেহেতু আমাদের দেশটা একটা ধর্মভীরু দেশ, লোকজন ধর্ম নিয়ে খুব অনুভূতিশীল, সেকারণে এই চেষ্টায় কিছুটা হলেও তারা সফল হয়েছে।"
তবে জেনারেল হারুন বলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে সেই অবস্থা এখন আর নেই।