আমেরিকা সক্রিয়তা ভাবাচ্ছে বেজিংকে, চিন ও তাইওয়ানের মধ্যে সম্পর্ক ও উত্তেজনার নেপথ্যে কোন কারণ
আমেরিকা সক্রিয়তা ভাবাচ্ছে বেজিংকে, চিন ও তাইওয়ানের মধ্যে সম্পর্ক ও উত্তেজনার নেপথ্যে কোন কারণ
মার্কিন কংগ্রেস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর ঘিরে ইতিমধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। পেলোসির সফরের সময় প্রায় ২৭টি চিনা যুদ্ধ বিমান তাইওয়ানের আকাশসীমায় ঢুকে যায়। এই সফরের পরিণাম ভালো হবে না বলেও চিন আমেরিকাকে হুমকি দিয়েছে। তাইওয়ান প্রণালী অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করছে চিন। অন্যদিকে, তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে আমেরিকার সামরিক সক্রিয়তা দেখতে পাওয়া গিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা তৃতীয় যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন।
পেলোসির তাইওয়ান সফরে চিনের ক্ষোভের কারণ
আগেও তাইওয়ান সফরে মার্কিন সচিব এসেছেন। ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তাইওয়ান সফরে এসেছিলেন তৎকালীন মার্কিন বিদেশ সচিব। কিন্তু পেলোসির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আলাদা। পেলোসি মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার। মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকারের ক্ষমতা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের পরেই থাকে। গত ২৫ বছরে আমেরিকায় কোনও শীর্ষস্থানীয় মার্কিন আধিকারিক সফর করেনি। পেলোসির এই সফরের আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, তাইওয়ানের ওপর নজর রয়েছে। পরিস্থিতি পড়লে সামরিক সাহায্য পাঠাতে আমেরিকা দ্বিধা করবে না। প্রসঙ্গত, চিন তাইওয়ানকে তাদের একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে দেখে। যদিও তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র বলে। এখানকার সংবিধান নিজস্ব। নিজস্ব গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকার গঠন হয়।
তাইওয়ানের ভৌগলিক গুরুত্ব
দক্ষিণ-পূর্ব চিনের উপকূল থেকে ১০০ মাইল দূরে তাইওয়ান অবস্থিত। এটি একটি দ্বীপ। তবে প্রথম থেকে আমেরিকা তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত করে। তাইওয়ানের সঙ্গে আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বেশ ভালো। তা মোটেই ভালো চোখে দেখে না চিন। তাইওয়ান ইস্যুতে মাঝে মাঝেই আমেরিকাকে চিন হুমকি দেয়। তবে তাইওয়ানকে নিয়ে আমেরিকার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। তাইওয়ান চিনের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। যার ফলে আমেরিকার গুয়াম ও হাইওয়াই পর্যন্ত চিনের নজরে চলে আসবে। মার্কিন সামরিক ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
তাইওয়ান কি সব সময় চিনের থেকে আলাদা
ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, ১৭ শতকে প্রথম তাইওয়ান চিনের দখলে চলে আসে। সেই সময় চিনকে একটি রাজপরিবার শাসন করত। ১৮৯৫ সালে চিন জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যায়। সেই সময় তাইওয়ান জাপানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আবার ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর জাপানের থেকে তাইওয়ান চিনের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী সরকারি বাহিনী ও মাও সে তুংয়ের বাহিনীর মধ্যে চিনা মূল ভূখণ্ডে সংঘর্ষ হয়। মাও সেতুংয়ের দল জয়ী হয়। ১৯৪৯ সালে চিনে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। সেই সময় চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী সরকারি বাহিনীর অবশিষ্ট সেনা তাইওয়ানে পালিয়ে যায়। গত কয়েক দশক ধরে তারা তাইওয়ানে শাসন করছে।
তাইয়ান নিজেদের রক্ষা করতে পারবে
চিন তাইওয়ানের সঙ্গে বাণিজ্যি সম্পর্ক বাড়াতে পারে। তবে তাইওয়ানের সঙ্গে এমনিতেও সুসস্পর্ক নেই। তবে সামরিক দিক থেকে চিনের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা তাইওয়ানের নেই। আমেরিকার পর চিন সামরিক খাতে সব থেকে বেশি খরচ করে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির চিনের সামরিক অস্ত্র অনেকের ভয়ের কারণ হতে পারে। তবে তাইওয়ানকে সামরিক দিক থেকে আমেরিকা সাহায্য করতে পারে। সেনা বা সামরিক অস্ত্র দিয়ে সেই সাহায্য হতে পারে। সম্প্রতি এই বিষয়ে জো বাইডেনের একটি বিবৃতিতে সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়েছে। তবে আমেরিকা কীভাবে তাইওয়ানকে সাহায্য করবে, সেই বিষয়ে কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই বলেই আন্তর্জাতিক মহল মনে করছে।
পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে
তাইওয়ানের সঙ্গে চিনের পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। ২০২০ সালে তাইওয়ান প্রথম চিনা বিমানের তাদের আকাশ সীমায় অনুপ্রবেশের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনে। ২০২১ সালে চিন তাইয়ানের এয়ার ডিফেন্স জোনে সামরিক বিমান পাঠিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে। চিন তাইওয়ানে স্বঘোষিত এলাকা থেকে বিদেশি বিমানগুলোকে চিহ্নিত ও পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। ২০২১ সালে অক্টোবরে তাইওয়ান একটি রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনে। সেখানে দেখা যায়, তাইওয়ানের আকাশসীমায় ৫৬টি বিমানের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল।
বিশ্বের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ তাইওয়ান
প্রযুক্তির দিক থেকে ও বাণিজ্যিক দিক থেকে বিশ্বের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ তাইওয়ান। বিশ্বের বেশিরভাগ দৈনন্দিন ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম যেমন ফোন, ল্যাপটপ, ঘড়ি, গেম কনসোল তাইওয়ান থেকেই তৈরি হয়। তাইওয়ানের কোম্পানি তাইওয়ান সেমিকনডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিক কোম্পানি বিশ্বের ইলেকট্রনিক্স বাজারে অর্ধেকের বেশি অংশ জুড়ে রয়েছে।
কী ভাবছেন তাইওয়ানের সাধারণ মানুষ
তাইওয়ানের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক ভালো নয়। একদিকে, চিন যেমন তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করছে। অন্যদিকে, তাইওয়ান স্বাধীন রাষ্ট্রমনে করে। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, তাইওয়ানের সাধারণ নাগরিকরা অপেক্ষাকৃত শান্ত। ২০২১ সালের অক্টোবরে চিনের সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। সেই সময় তাইওয়ান পাবলিক ওপিনিয়ন ফাইন্ডেশনের তরফে একটি সমীক্ষা করা হয়। সেখানে দুই তৃতীয়াংশ মানুষ বা ৬৪ শতাংশ সাধারণ নাগরিক জানিয়েছিলেন, তাঁরা মনে করেন না এই পরিস্থিতিতে চিনের সঙ্গে তাইওয়ানের কোনও যুদ্ধ হতে পারে। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, তাইওয়ানের বেশির ভাগ মানুষ নিজেদের স্বাধীন স্বতন্ত্র দেশের নাগরিক বলে মনে করেন। ৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে একটি সমীক্ষায় দেখা দেয়, তাইওয়ানে চিনা বংশোদ্ভূতদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে। সাধারণ নাগরিক তাইওয়ানকে স্বাধীন হিসেবে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।